আজকের দিনে আধ্যাত্মিকতার নামে অনেকেই নিজেদেরকে “নতুন পথপ্রদর্শক”, “সত্যের বাহক”, এমনকি “জীবন্ত ধর্মগ্রন্থ”-এর বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেন। তারা কখনোই সরাসরি বলেন না “আমি নবী”, কিংবা “আমি নতুন ধর্ম দিচ্ছি”। তারা বলেন, “আমি শুধু পথ দেখাচ্ছি”, “আমি কথা বলি না, আমার ভিতর থেকে আসে” এমনসব বিমূর্ত এবং অস্পষ্ট ভাষায় এক নতুন বিশ্বাসের বীজ বপন করে দেন।
সম্প্রতি একজন আত্মঘোষিত আধ্যাত্মিক গুরু অনেক দূর থেকে এসে আমার এবং আমার আশেপাশের মানুষদের সাথে দেখা করেন। উদ্দেশ্য আমাদেরকে তাঁর দর্শনের আলো দেখানো। প্রথমে শ্রদ্ধা রেখেই তাঁর কথা শুনলাম, তাঁর কথায় আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলাম। কিন্তু যতই আলাপ এগোয়, ততই বিষয়গুলো স্পষ্ট হতে থাকে উনি আসলে গুরু না, বরং একজন বিভ্রান্তিকর মতবাদের প্রচারক।
তাহলে কি “দর্শনের” মোড়কে নতুন ধর্ম?
তিনি বললেন,
“আমি কোন ধর্ম প্রচার করছি না। তবে আমাদের পথে সত্যের ৫ টি ভিত্তি – সৎ চিন্তা, সৎ কল্পনা, সৎ দৃষ্টি, সৎ কর্ম ও সৎ জীবিকা। এই ভিত্তি মেনে বর্তমান পালন করলে ঈশ্বর নিজেই ধরা দিবে। অন্য ধর্মগুলোর মতো সাধনা বা প্রার্থনার দরকার নেই।”
এই কথাগুলো শোনার পর মনে হয় এ তো সাধারণ নৈতিকতা। তবে এখানেই একটি স্পষ্ট বিপদ দেখা দেয়। ধর্ম মানেই শুধু নামাজ-রোজা না; ধর্ম মানে বিশ্বাস, নিয়ম, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুক্তির পথ। অথচ উনি স্পষ্টভাবে বলছেন,
“পুরনো ধর্মগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এখনকার যুগে আমি নিজেই সেই সত্যের ধারক। কোরআন তখনকার জন্য এবং তার কিছু পর পর্যন্ত ঠিক ছিল, আর এখন আমি নিজেই কোরআনের ধারাবাহিকতা।”
এই বক্তব্য একটি নতুন মতবাদ বা ধর্ম-এর সূচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু তিনি সেটিকে “দর্শন”, “আত্মপ্রকাশ”, “অটোমেটিক উপলব্ধি” ইত্যাদির মাধ্যমে আড়াল করে রাখেন। যাতে ভক্তরা স্বাভাবিক ভাবেই ভেবে বসে “উনি নিশ্চয়ই কোন এক উচ্চস্তরের মানুষ, যাকে চিনতে গেলে অনেক ভেতরের চোখ লাগবে।”
নিজেকে গুরুর মর্যাদা না দিয়েই গুরু সাজার কৌশল?
আধ্যাত্মিক গুরুদের একটি মৌলিক গুণ হল তারা কখনোই নিজেকে জোর করে চাপিয়ে দেন না। বরং তারা বলেন, “যদি আলো তোমার ভিতরে জ্বলে, তবে আমায় অনুসরণ করো।” কিন্তু এই ব্যক্তি বলেন,
“আমি কিছু বলি না, আমার ভিতর থেকে অটোমেটিক চলে আসে।”
তাঁর কথাগুলো আত্মপ্রকাশের নামে এমনভাবে সাজানো, যেন প্রশ্ন করাটাও একরকম “অপবিত্রতা” হয়ে দাঁড়ায়। শিষ্যদের বলা হয়, “প্রশ্ন করো, কিন্তু মেনে নাও একজন গুরু লাগবেই। বর্তমান পালন না করলে তুমি আলোর পথ থেকে দূরে সরে যাবে।”
এভাবেই আস্তে আস্তে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব তৈরি হয়, যেখানে যুক্তি ও বিবেক ত্যাগ করাই “আত্মসমর্পণ” হিসেবে প্রশংসিত হয়।
কোরআন ও রাসূল নিয়ে এমন বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা কি কেউ দিতে পারে?
সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো তিনি কোরআন এবং নবী মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে এমন ব্যাখ্যা দেন যা সরাসরি ইসলামের মূল বুনিয়াদকে অস্বীকার করে। তিনি বলেন,
“কোরআন ওই সময়ের জন্য ঠিক ছিল, এখন বিকৃত হয়ে গেছে। এখন আমি নিজেই সেই পথ, নতুন প্রেরণা।”
এটা স্পষ্টতই ইসলামের চূড়ান্ত সত্য, রাসূলের চূড়ান্ততা এবং কোরআনের চূড়ান্তত্ব-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলাম যেখানে বলে, “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণ করে দিলাম…” (সূরা মায়িদাহ, আয়াত ৩)
তিনি সেখানে বলেন, “আমি এখনকার যুগের জীবিত কোরআন, আমাকে ছাড়া পথ নেই।”
এ ধরনের বক্তব্য নতুন রাসূলত্ব দাবি করার এক ধরনের আড়াল। যদিও তিনি সরাসরি “আমি নবী” বলেন না, কিন্তু তাঁর ভাষা, ভঙ্গি ও ভাবধারা সব কিছুই সেই দিকে ইঙ্গিত করে।
ঈশ্বর কি এমন কথা বলবেন?
তিনি আরও বলেন,
“আমাদের পথে এলেই ঈশ্বর মিলবে না, কয়েক বছর সাধনা করতে হবে। তবে আমি কিছু দিব না, তুমি নিজেই জীব সেবা করবে যতক্ষণ তোমার চেতনা থাকবে। প্রাথমিকভাবে শুরু হবে ২১ দিন বর্তমান পালনের মাধ্যমে।”
অথচ ঈশ্বর নিজেই কোরআনে বলেন, “আমি তোমার গলার শিরার চেয়েও নিকট (সূরা ক্বাফ, আয়াত ১৬)।” তাহলে এই গুরুর কথা অনুযায়ী, দীর্ঘ সাধনা ছাড়া ঈশ্বর মেলে না; এই কথা কি ঈশ্বরের কথা?
একজন সত্যিকারের গুরুর বৈশিষ্ট্য কী?
একজন প্রকৃত আধ্যাত্মিক গুরুঃ
- প্রশ্নকে ভয় পান না, বরং উৎসাহিত করেন
- নিজেকে আলোর উৎস না বলে, আলোর দিক দেখানো বাতিঘর মনে করেন
- পূর্ববর্তী নবী ও ধর্মকে অবমাননা করেন না
- মানুষের বিবেক ও বুদ্ধিকে জায়গা দেন
- ধর্ম, দর্শন বা পথপ্রদর্শনের নামে কাউকে দাসত্বে বাধেন না
এই আধ্যাত্মিক গুরুর আলোচনায় এগুলোর কোনোটিই স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না।
সারকথা
আধ্যাত্মিকতা মানে আলো, বিশুদ্ধতা, সহজতা। সেখানে যদি কিছু “গোপন নিয়ম”, “আত্মবিলোপের প্রতিজ্ঞা”, “পুরনো ধর্ম বাতিল” এবং “একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে মুক্তি” হয় তাহলে সেটা ধর্ম নয়, একধরনের বিকৃত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা।