একজন বললেন, “আধ্যাত্মিক সাধনায় গুরু থাকা বাধ্যতামূলক। যার গুরু নাই, সে ভূল পথে হাঁটে। হয়তো ভাল মানুষ হবে, কিন্ত তার মুক্তি হবেনা।”
তার কথা অনুযায়ী, মুক্তি মানে হলো এমন এক চূড়ান্ত অবস্থা যেখানে আর কোনো পুনর্জন্ম নেই, আর কোনো ঘুরে ফিরে আসা নেই। এবং সেই পথের দিশা একমাত্র দিতে পারেন একজন ‘গুরু’। এমন গুরু, যাঁকে নিজের ‘আমিকে’ সঁপে দিতে হয়। যাঁর ইচ্ছা হয়ে যায় আপনার ইচ্ছা। তখন আপনি আর আপনি থাকেন না, আপনার ভেতরে থাকে শুধু গুরু।
এই ধারণাটা শুনতে শক্তিশালী, কিন্তু প্রশ্নও তো উঠেঃ
“আমি যদি সত্যকে খুঁজি, তবে কেন আরেকজন মানুষের ইচ্ছায় নিজের অস্তিত্ব বিলীন করতে হবে?”
ধরুন আপনি নিজের পথ নিজেই খুঁজতে চান। আপনি হয়ত ধর্মীয় বা সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। এখন আপনি ভাবলেন সব ছেড়ে একা ধ্যান করবেন, নতুন নিয়মে নিজেকে গড়বেন। প্রতিদিন আধাঘণ্টা গাছের নিচে বসে থাকবেন, শুধু নিজের সত্ত্বার খোঁজে।
তখনই আসে দ্বিতীয় প্রশ্নটা,
“আমি যদি আবার একটা নিয়মেই নিজেকে বেঁধে ফেলি, তাহলে সেটা অন্যান্য ধর্মীয় নিয়মগুলো থেকে আলাদা কীভাবে?”
ইশ্বর কি আমাদের নিয়মে বেঁধে ফেলতে চান? না কি তিনি বলেনঃ
“খুঁজো আমাকে। আমি আছি তোমাদের শিরার চেয়েও নিকটবর্তী।”
আপনার মধ্যে যদি প্রশ্ন জাগে,
“এই গুরুপন্থা কি সত্যিকারের মুক্তি, নাকি আরেক রকম দাসত্ব?”
তবে সেটাই আসল বোধের জন্ম।
আমরা যখন বলি, “গুরু ছাড়া মুক্তি নাই” তখন সেটাও তো এক ধরণের বিশ্বাস। আর বিশ্বাস মানেই সন্দেহের বিপরীতে দাঁড়ানো। কিন্তু ইশ্বর যদি সত্যিই সর্বজ্ঞ, সর্বজ্ঞাপক হন, তবে কি তিনি আমাদের সন্দেহ, প্রশ্ন, অনুসন্ধান এসবকে ভয় পাবেন?
নাকি তিনি বলবেন,
“আরে, আসো, খুঁজো আমাকে। আমাকে প্রশ্ন করো। আমি তোমাদের অপেক্ষায় আছি!”
একজন গুরু আপনারকে পথ দেখাতে পারেন। কিন্তু সেই পথে কিন্ত আপনিই হাঁটবেন। গুরু আপনাকে জোর করতে পারেন না। তিনি পারবেন শুধু আলো দেখাতে। যদি গুরু নিজের ইচ্ছাকেই আপনার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বানিয়ে ফেলেন, তবে আপনি কি সত্যিই মুক্ত? নাকি একটা নতুন নিয়মে আটকে গেলেন?
গুরু-সংস্কৃতি: ইতিহাস আর হৃদয়ের টান
ঐতিহাসিকভাবে গুরু বা পথপ্রদর্শক ছিল আধ্যাত্মিক অভিযানের অংশ। গুরু মানে শুধু একজন শিক্ষক নয়, অভিজ্ঞতার উৎস, এক চলমান আলোকবর্তিকা। ঋষি-মুনি যুগ থেকে শুরু করে সুফি-দরবেশ পর্যন্ত এই ধারণা ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে।
গুরুকে বলা হয় ‘দ্বাররক্ষক’, তিনি জানেন কোন দরজায় সত্য লুকিয়ে আছে। আর শিষ্য হলেন সেই যে প্রস্তুত, বিনীত, অনুসন্ধানী।
তবে গুরু ধারণায় বিপদ কোথায়?
যখন গুরুর মুখ হয়ে যায় ঈশ্বরের একমাত্র কণ্ঠ।
যখন গুরু নিজেকে করেন ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ অথবা আরও ভয়ঙ্করভাবে, ঈশ্বরের সমতুল্য।
তখন শিষ্য আর খোঁজেন না ঈশ্বরকে, তিনি শুধু দেখেন গুরুকে।
এইখানেই এক চুপচাপ বিপদ লুকিয়ে থাকে, ভক্তি আর পরাধীনতা এক সময় একে অন্যের মতো দেখতে হয়ে যায়।
ঈশ্বর কি এমন কঠিন পথেই ডাকেন?
ধরুন, আপনি নিজের ভেতরে একটা ডাক শুনছেন। আপনি বুঝতে পারছেন, ‘আমি কেবল রীতিনীতি মেনে জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছি না।’ তখন আপনি হয়ত গুরুর কাছে যেতে চাচ্ছেন না। আপনি চাচ্ছেন নির্জনে, গাছের নিচে বসে, নিজের ভেতরে ডুব দিতে। আধাঘণ্টা ধ্যান, নিজেকে প্রশ্ন, নিজের আবেগকে দেখা।
তখন কেউ এসে বলল,
“না না, এটা বিপজ্জনক! গুরু ছাড়া এটা করলে তুমি বিভ্রান্ত হবে।”
ইশ্বর কি মুক্তি এমন কঠিন পথেই দেন?
না। কোরআনে বলা হয়েছেঃ
“আমি তোমার শিরার চেয়েও নিকটবর্তী আছি।” (সূরা ক্বাফ: ১৬)
এই কথা কী বলে?
ঈশ্বর দূরে নয়। তিনি এমন কেউ নন, যাঁকে গুরুর পাসওয়ার্ড ছাড়া পাওয়া যায় না।
ঈশ্বর কি ভয় পান?
একটা বড় প্রশ্ন এখানে আসে,
“ঈশ্বর যদি সত্যিই ঈশ্বর হয়, তবে সে কি প্রশ্নে কাঁপে?”
না। ঈশ্বর কখনও ভয় পান না। ঈশ্বর চান মুক্ত অন্বেষণ।
যদি আপনি ঈশ্বরের পথে বেরিয়ে পড়েন, নিজের ভুল থেকে শেখেন, নিজের মতো করে ঈশ্বরকে ডাকেন, তাহলে সেটাও কি ঈশ্বরেরই পথ নয়?
ঈশ্বর কি বলবেন,
“তুমি আমাকে খুঁজলে, কিন্তু আমার অনুমোদিত গুরু ছাড়া খুঁজলে, তাই আমি তোমায় গ্রহণ করব না?”
এটা কি ঈশ্বরের ভাষা? নাকি মানুষের বানানো ভয়? তাহলে কেউ যদি প্রশ্ন তোলে, “আমি কেন গুরুর ইচ্ছায় নিজেকে বিলীন করব?” তাকে কেন ভয় দেখানো হবে?
সত্যিকারের ঈশ্বর বরং বলেন, “খুঁজে দেখো, চিনে নাও, আমি তো তোমার মধ্যেই আছি।”
গুরু না থাকলে কী হয়?
অনেকে বলবেন, নিজের পথ নিজে হাঁটলে আত্মবিভ্রমে পড়তে হয়। ঠিক কথা। নিজের অহংকার, ইগো, মায়া সব মিলিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু তাই বলে কি গুরু ছাড়া যাত্রা অসম্ভব?
যদি সত্যিই গুরুর প্রয়োজন হয়, তবে সেই গুরু কি আপনি নিজের অন্তরে খুঁজে পাবেন না?
হয়ত একজন শিক্ষক, একজন বন্ধু, একজন সাধক যাঁর কথা আপনার হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে দেয়। যদিও সেটাও আপনারই ভেতরে।
তবে ভয় তখনই, যখন গুরু হয়ে যায় আপনার সবকিছুর মালিক। তখন আপনার নিজের ভেতরের সত্য বলার অধিকারও যেন কেড়ে নেয়া হয়।
মুক্তির পথ কি আত্মসমর্পণ, না আত্ম-জাগরণ?
এই প্রশ্নটাই আসল।
গুরুর কাছে আত্মসমর্পণ করা মানে কি নিজেকে মুছে ফেলা? নাকি নিজের অহংকার ত্যাগ করা?
এই দুইটা বিষয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে।
যদি গুরু আপনাকে বলেন, “নিজের চেতনা জাগাও, নিজের ভেতরের ঈশ্বরকে চিনো” তাহলে তিনি প্রকৃত গুরু।
আর যদি বলেন, “আমাকেই ঈশ্বর মনে করো” তাহলে সেটা গুরু না, সেটা এক মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব।
মুক্তি মানে তো আত্ম-জাগরণ। নিজেকে চেনা, নিজেই ঈশ্বরকে অনুভব করা।
শেষ কথা: মুক্তির পথে ভয় নয়, ভালোবাসা থাকুক
যদি কেউ গুরুর পথ বেছে নেয়, সেটা তার পথ। যদি কেউ একা ধ্যান করে মুক্তি খোঁজে, সেটাও পথ।
কিন্তু ভয় দেখিয়ে, “গুরু বিনা গতি নাই” বলে রাস্তায় ঠেলে দেওয়া কখনো মুক্তির পথ হতে পারে না।
মুক্তি মানে নিজের মধ্যে সেই আলো জ্বালানো, যেখানে ঈশ্বর নিজের মতো করে ধরা দেয়।