বাংলা উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে ‘গুরু’ শব্দটি বহুবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও তিনি এক পরম শক্তির প্রতিনিধি, কোথাও বা একজন মানবিক পথপ্রদর্শক। কেউ কেউ গুরুকে অন্ধভাবে মানেন, আবার কেউ তাঁর মাধ্যমেই নিজেকে খুঁজে ফেরেন। ফকির লালন শাহ সেই দ্বিতীয় পথের প্রবক্তা। এই লেখায় আমরা বিশ্লেষণ করবো একজন আধ্যাত্মিক গুরুকে মানা আর ফকির লালনের “গুরুতত্ত্ব” এক জিনিস কি না।
আধ্যাত্মিক গুরু: বাহ্যিক নির্দেশক, নাকি আত্মিক চাবিকাঠি?
আধ্যাত্মিক গুরু বলতে সাধারণত আমরা এমন একজনকে বুঝি, যিনি কোনো আধ্যাত্মিক পথের জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং অন্যদের সে পথে চালিত করেন। তিনি দীক্ষা দেন, আচরণবিধি শেখান, সাধনার পদ্ধতি বাতলে দেন। বিভিন্ন ধর্মে যেমনঃ সুফিবাদে পীর, হিন্দুধর্মে গুরু, বৌদ্ধধর্মে আচার্য, খ্রিষ্টধর্মে যাজক, এরা সকলেই একধরনের বাহ্যিক পথপ্রদর্শক।
এই গুরুদের প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য অনেকসময় এত প্রবল হয় যে অনুসারীরা তাঁদেরকে প্রশ্নাতীত সত্য হিসেবে মানেন। অনেক সময় এই আনুগত্য এক ধরনের ব্যক্তিপূজার রূপ নেয়।
ফকির লালনের গুরুতত্ত্ব: ভিতরের আত্মার দিকেই দৃষ্টি ফেরানো
লালনের গানে গুরু শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট মানুষ নন, বরং তিনি এক আত্মিক উপলব্ধি যিনি মানুষকে আত্ম-সত্যের দিকে চালিত করেন। ফকির লালনের কথায়ঃ
“আপন গুরু আপনি চিন, গুরুর তত্ত্ব গুরুর ভিতর বিন।”
এখানে ‘আপন গুরু’ মানে হলো সেই ‘চেতনার দীপ্তি’ যা আপনার ভিতরেই লুকিয়ে আছে। গুরুর সাহায্য দরকার, তবে সেই গুরু আপনাকে আপনাকেই চিনিয়ে দেন, তাঁর নিজস্ব মতবাদ বা ভক্তি দাবি করেন না। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত গানঃ
“গুরু বিনে গতি নাই রে, সত্য বলি।
তারে চিনলে আপনারে চিনতে পারবি।”
এই লাইন থেকে বোঝা যায়, লালনের কাছে গুরু সে-ই, যার মাধ্যমে আপনি নিজের প্রকৃত রূপ চিনতে পারেন, কোনো বাহ্যিক আচার নয়, বরং অন্তরের জাগরণই সেখানে মুখ্য।
গুরু কি এক ব্যক্তি, না এক চেতনা?
অনেক আধ্যাত্মিক পথে গুরুকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তিনিই ঈশ্বরের রূপ। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একজন গুরু তাঁর শিষ্যদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তবে লালনের দৃষ্টিতে:
- গুরু কোনো এক ব্যক্তি হতে পারেন, তবে তিনি শুধুই বাহ্যিক চিহ্ন;
- মূল গুরু আপনার ভিতরকার চেতনা, যার আলোয় আপনি নিজেকে খুঁজে পান;
- গুরু আপনাকে নিজের সত্য চেহারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, কোনো মতবাদে বাঁধেন না।
তাহলে, লালনের গান গাওয়া ও বাহ্যিক গুরুকে মানা কি বিরোধী?
এখানেই আসল প্রশ্ন। কেউ যদি ফকির লালনের গান করেন, আবার একই সাথে এমন একজন গুরুকে মানেন যিনি নিজেকে সর্বোচ্চ দাবি করেন, শিষ্যের চিন্তাচর্চার স্বাধীনতা সীমিত করেন, তাঁকে নতুন ধর্ম বা মত মানতে বাধ্য করেন, তবে সেটা লালনের “মুক্ত” চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।
কিন্তু যদি কেউ এমন একজন গুরুর শরণ নেন, যিনি তাঁকে নিজেকে চিনতে সাহায্য করেন, চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেন, কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতার গণ্ডিতে বাঁধেন না, তাহলে সেটা লালনের গুরুতত্ত্বের কাছাকাছি বলা যায়।
আধুনিক সময়ে গুরুতত্ত্বের চ্যালেঞ্জ
আজকের যুগে বহু মানুষ গুরুর নামে মুগ্ধতা বা ভক্তিতে মগ্ন হয়ে পড়ে নিজের আত্ম-উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে যায়। অনেক ‘গুরু’ মানুষকে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, বরং মুক্ত করতে চান না। লালনের গুরুতত্ত্ব আমাদের শেখায় আপনার বিশ্বাস যতই গভীর হোক, প্রশ্নহীন আনুগত্য নয়, বরং আত্ম-অন্বেষণের পথই প্রকৃত সাধনা।
শেষকথা
ফকির লালনের গুরু একাধারে পথ, আলো ও আয়না যার মাধ্যমে আপনি নিজের ভেতরের অচেনা চেহারাটি চিনে নিতে পারেন। বাহ্যিক গুরু যদি আপনাকে সেই আলোয় পৌঁছাতে সাহায্য করেন, তবে তিনি লালনের গুরুর সঙ্গে মেলে। কিন্তু যদি তিনি আপনাকে নিজের চেতনার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান, তবে সেটা লালনের দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত।
লালনের পথ একটাই কথা বলে, “যদি গুরু চিনতে চাও, নিজের ভিতর তাকাও” এবং এটাই একজন সাধকের কাছে চরম সত্য।