রাত নেমেছে তখন, নরম কুয়াশার মতো অন্ধকার চাদরে ঢাকা পড়েছে সাওতা গ্রাম। আমি, সায়েম, নিশাদ, অর্জুন, রাইফ আর রাফি; আমরা ছয়জন একসাথে চলেছি সাত্তার ফকিরের আশীর্বাদ নিতে। বৃদ্ধ সাধক, যার নাম বহু দূর থেকে শ্রদ্ধাভরে শুনেছি। ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা; অজানা, অথচ অচেনা নয়।
প্রথমেই ভুল করলাম। ভুল বাড়িতে গেলাম। গিয়ে শুনলাম সাত্তার ফকির নাকি মেয়ের বিয়েতে গেছেন। সন্দেহ দানা বাঁধলো, আর অনুসন্ধান শুরু করতেই সঠিক বাড়ি খুঁজে পেলাম। নিঃশব্দ রাতে আমাদের খোঁজার কাহিনী যেন অদৃশ্য কোনো হাতে লেখা হয়েছিল।
যখন পৌঁছালাম, তখন রাত প্রায় দশটা। সাত্তার ফকির শুয়ে ছিলেন। তবুও, আমাদের উপস্থিতিতে তিনি ক্লান্ত মুখে মৃদু হাসলেন। প্রশ্ন করলেন আমাদের নাম, পরিচয়, কোথা থেকে এসেছি। তার কন্ঠস্বর ধীর কিন্তু গভীর, যেন শব্দের মধ্যে বয়ে চলেছে বহু বছরের সাধনার ধারা।
তিনি বললেন,
“আগে গাইতাম, তখন শক্তি ছিল। এখন গাইতে পারি না, লিখতেও পারি না। তবে মনের ভেতর এখনো গান বাজে। গান কি আর থামানো যায়?”
তার কথা শুনতে শুনতে আমি অনুভব করলাম, “শরীর ক্ষয়ে গেলেও, আত্মার সুর কখনো মরে যায় না”।
তিনি আমাদের চৌকির নিচ থেকে একটা চালের কৌটা বের করতে বললেন। সায়েম তা হাতে ধরিয়ে দিলে, তিনি ইশারায় বললেন, আমাদের কাছেই রাখতে। তারপর উঠলেন, চোখেমুখে দারুণ মমতা। বললেন,
“একটু করে চাল খাও, খেয়ে পানি খাও। দূর থেকে এসেছ। বিশ্রাম নাও।”
নজু নামের একজনকে ডেকে বললেন এক জগ ঠান্ডা পানি আনতে। আরো বললেন, আমাদের গানের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে। তার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আতিথেয়তার যে প্রাচুর্য, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
একটি ছোট্ট ছেলে আমাদের নিয়ে গেল, ওয়াশরুম দেখিয়ে দিল, মটর চালিয়ে ফ্রেশ হবার পানি তুলে দিল। তার আচরণে মনে হচ্ছিল, যেন সে আমাদের অনেকদিনের চেনা; অথচ, আজই প্রথম দেখা।
সেবা (চাল-পানি আর রাতের খাবার) নিয়ে আমরা একটু বিশ্রাম করলাম। নিশাদ হঠাৎ বলল,
“চলেন, লালন সাঁইজির আখড়ায় যাই।”
সবাই সম্মত হলে সাত্তার ফকিরের স্ত্রী (অসাধারণ ভালো একজন মানুষ) এর কাছে অনুমতি নিয়ে রওনা দিলাম। পাড়ায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, গান এখানে এখন না করাই ভালো হবে। রাতের নীরবতা যেন আমাদের পা টেনে টেনে নিয়ে গেল অন্য কোথাও।
সাঁইজির আখড়ায় গিয়ে শুনলাম, দশটার পর আখড়ার ভেতর গান নিষিদ্ধ। বারোটায় গেট বন্ধ হবে।
তবুও গানের ক্ষুধা আমাদের স্থির থাকতে দিল না। আখড়ার বাইরের স্টেজের পাশে কালীগঙ্গা নদীর ঘাটে গিয়ে একটা পুরনো গাছের নিচে বসলাম। ফুরফুরে বাতাস এসে লাগছিল গায়ে, পুকুরের পানিতে কচুরিপানাগুলো যেন ঢেউ খেলছিল মৃদু আলোয়।
নিশাদ গান ধরলো। হঠাৎ কিছু যুবক এসে কথায় কথায় মনোযোগ নষ্ট করতে লাগলো। বিরক্ত হয়ে নিশাদ বলল,
“চলেন ওইখানে যাই।”
আমরা সরে গেলাম, আরেকটা গাছের নীচে। নিশাদ, অর্জুন আর আমি মিলিয়ে একটা গান ধরলাম। এতক্ষণে প্রাণ পেলাম। রাতের আকাশের নিচে, মাটির গন্ধের সাথে গানের সুর মিশে গেল।
রাত গড়াতে গড়াতে গান জমে উঠলো। সাধক আর পাগলরা এসে জুটলো। কেউ মন্দিরা বাজাল, কেউ হাতে তালি দিল। কে কোথা থেকে এলো, কে বা কোথায় হারিয়ে গেল সেসবের কোনো হিসেব ছিল না। শুধু গান ছিল, মন ছিল, নির্জনতার মধ্যে প্রাণ ছিল।
ফজরের আজান পড়তেই গান থেমে গেল। আমরা ছয়জন গানের আসর ছেড়ে নদীর ঘাটে গেলাম। ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে আমি চুপ করে ঘাটের এক পাশে ধ্যানে বসলাম। গুরুত্বপূর্ণ কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই। নিঃশব্দে। শুধু নিজের ভেতর ডুব দিতে।
চোখ বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম পাখিদের ডাকে একধরনের বদল এসেছে। দিনের আলোর আগমনী বার্তা।
ঠিক আধাঘণ্টা পর এলার্ম বেজে উঠল। চোখ খুলতেই বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম, সমগ্র পুকুর জুড়ে হাজার হাজার কচুরিপানার ফুল ফুটে আছে। সেই দৃশ্য যেন কোনো স্বপ্নের খোলা জানালা।
অর্জুন আর নিশাদ পাশেই একটা গাছের নিচে গল্প করছিল। রাফি আর রাইফ বসে ছিল ঘাটের কিনারায়। সায়েম গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে বেঞ্চে শুয়ে পড়েছিল যুদ্ধ করা ক্লান্ত সৈনিকের মতো, টানা ৩৬ ঘণ্টা ঘুমহীন।
আমরা গানের আসরে যন্ত্রপাতি রেখেই গিয়ে বসেছিলাম ঘাটে। সেখানে থেকে গিয়েছিল শুধু পাগল আর সাধকরা।
তারপর এল আরেক পাগল, যে রুমের কথা বলে ঘন্টাখানেক ঘোরালো, টাকা নিয়ে গেল। বুঝলাম, এই দুনিয়ায় সাধনাও যেমন আছে, ছলনাও আছে।
শেষমেশ আমরা লালন ফকিরের আস্রমে আশ্রয় নিলাম। গেট পেরিয়ে ঢুকতেই দেখলাম কিছু মানুষ গাছে ঝাঁকি দিয়ে বেল পাড়ছে। আমরা সাবধানে বেলতলা পাড় হয়ে গিয়ে অডিটোরিয়ামের নিচে জায়গা খুঁজে শুয়ে পড়লাম।
এক ভদ্রমহিলা আমাদের বিশাল চাদর আর বালিশ দিলেন। সবার মাথার নিচে কিছু না কিছু ছিল, শুধু আমার ছিল না। তিনি আমাকে আরেকটা ছোট্ট বালিশ দিলেন। তাঁর প্রতি হৃদয়ের গভীর থেকে কৃতজ্ঞতা। কিছু মানুষ আছেন, যারা নিঃশব্দে আশীর্বাদ হয়ে থাকেন।
ঘুমের ভেতর দিয়েই দুপুর চলে এল। প্রথমে আমি উঠলাম, তারপর রাইফ। তখনো সবাই ঘুমাচ্ছে। একজন বালতিতে করে শরবত বিলিয়ে দিচ্ছিলেন, বেলের শরবত। জীবনে সেরা তৃপ্তি বোধহয় এরকমই হয়, অক্লান্ত পথচলা শেষে অচেনা হাতে এক গ্লাস সরল ভালোবাসা।
দুপুরে আবার সেবা এল। সাদা ভাত, সবজি, ডাল। প্রাণভরে খেলাম। তারপর সিদ্ধান্ত বদলে আমরা হেম আশ্রমে না গিয়ে ফিরে এলাম ক্যাম্পাসে।
পথে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল, আমরা কিছুই নিয়ে আসিনি, অথচ আমাদের অন্তরের ঝুলি যেন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।
চালের স্বাদ, কচুরিপানা ফুল, শরবতের মিষ্টি গন্ধ আর একটা নির্জন গানের রাত; এসবই তো জীবনের গোপন সঞ্চয়।