ইশ্বর কেন এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন?

এই প্রশ্নটি শুধু ধর্মীয় নয়, বরং দার্শনিক, আধ্যাত্মিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে বহু আলোচিত ও অনন্ত জিজ্ঞাসার একটি। ভিন্ন ভিন্ন দর্শন ও ধর্ম এ প্রশ্নের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছে। এই লেখায় আমি কয়েকটি প্রধান মতবাদ ব্যাখ্যা করছি, শেষে একটি বিশ্লেষণমূলক আধ্যাত্মিক উত্তর দিচ্ছি যা সত্যের খোঁজে থাকা একজন অনুসন্ধানকারীর জন্য সহায়ক হতে পারে।

ধর্মীয় ও দার্শনিক মতবাদ অনুসারে:

১. ইসলামিক দৃষ্টিকোণ:

আমি জিন ও মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছি শুধু আমার ইবাদতের জন্য। (সূরা আদ-ধারিয়াত, ৫৬)

  • এখানে ইবাদত বলতে কেবল নামাজ-রোজা বোঝানো হয়নি, বরং জীবনকে এমনভাবে গঠন করা যাতে সৃষ্টিকর্তাকে চেনা, উপলব্ধি করা এবং তার পথে চলাই মূল উদ্দেশ্য হয়।
  • আল্লাহ নিজেই বলেন, “তিনি ছিলেন এক গোপন সম্পদ, তিনি চাইলেন যেন তাঁকে কেউ চেনে। তাই সৃষ্টি করলেন।” (হাদীসে কুদসী)

২. হিন্দু দর্শন (উপনিষদ ও বেদান্ত):

  • ব্রহ্ম ছিলেন একমাত্র, অপরিবর্তনশীল।
  • কিন্তু যখন ব্রহ্মের মধ্যে “আত্মবিকাশের ইচ্ছা” উদিত হয়, তখন তিনি নিজেই বহুরূপে প্রকাশ হন, এটাই সৃষ্টি।
  • “একোহং বহুস্যাম্‌” আমি এক ছিলাম, বহু হতে চাইলাম।
  • সৃষ্টিকে লীলা (দেবতার খেলা) হিসেবেও দেখা হয়, স্রষ্টা নিজের চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন খেলাচ্ছলে।

৩. বৌদ্ধ দর্শন:

  • বুদ্ধ সৃষ্টির প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে বলেছেন: “এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো দুঃখ থেকে মুক্তি।”
  • অর্থাৎ, ‘পৃথিবী কেন সৃষ্টি হলো’ তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘কেন আমরা এতে আটকে আছি এবং কীভাবে মুক্তি পাব।’

৪. খ্রিস্টান ধর্ম:

  • ঈশ্বর সৃষ্টিকে ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন।
  • মানুষকে দিয়েছেন স্বাধীন ইচ্ছা (free will), যাতে সে ঈশ্বরকে ভালোবেসে, স্বেচ্ছায় তাঁর পথে চলে।
  • পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের গৌরব ও ভালোবাসা প্রকাশের জন্য।

৫. সুফি/মারেফতি দৃষ্টিকোণ:

  • ইশক বা ভালোবাসা এখানে মূল কথা।
  • স্রষ্টা নিজেকে নিজেরই আয়নায় দেখতে চেয়েছেন, তাই সৃষ্টি।
  • প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন নিজেই নিজের মাঝে, তাই সৃষ্টি করেছেন ‘অপর’ বা ‘জগত’।

দর্শন ও আধুনিক চিন্তাধারায়:

১. Existentialism (অস্তিত্ববাদ):

  • সৃষ্টির কোনো পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য নেই। মানুষ নিজেই তার জীবনের মানে খোঁজে।
  • জগৎ অর্থহীন হলেও মানুষ অর্থ দিতে পারে।

২. Scientific Perspective:

  • বিজ্ঞান সাধারণত উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলে না। Big Bang একটি ঘটনা মাত্র।

আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্য সত্য:

এখন প্রশ্ন হলো “আসলেই সত্যিটা কী?”

এই প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর হয়তো শুধু বিশ্বাসে নয়, উপলব্ধিতে পাওয়া যায়।

তবে একটি গভীর, যুক্তিসংগত, আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা হতে পারে,

জগৎ সৃষ্টি হয়েছে চেতনার বিকাশ ও নিজেকে জানার খেলায়।

আপনি যদি চেতনার একমাত্র সত্তা হতেন, চিরস্থায়ী, নিরব, নিঃসঙ্গ; আপনি কি কখনো জানতে পারতেন আপনি কে, যদি না কেউ আপনাকে প্রশ্ন করে?

স্রষ্টা যেন নিজেকেই জানার জন্য ‘অপর’ সৃষ্টি করেছেন এবং সেই ‘অপর’ হলেন আপনি, আমি, এই জগৎ।

তিনিই স্রষ্টা, তিনিই সৃষ্টি, আর তিনিই সৃষ্টির পেছনের প্রশ্ন।

এই সৃষ্টি যেন একটি আয়না, যেখানে চেতন সত্তা নিজেকে দেখতে পায়।

এ কারণে লালন বলেন,

“আপন গুরুরে আপনি চিন, গুরুর তত্ত্ব গুরুর ভিতর বিন”
এখানে ‘আপন’ মানে আত্মার গভীরে যে সত্য, সেই চেতনাতেই স্রষ্টার সাক্ষাৎ।

উপসংহার:

ইশ্বর কেন এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন?

  • কারো মতে ইবাদতের জন্য,
  • কারো মতে প্রেমের জন্য,
  • কারো মতে অস্তিত্বের লীলাখেলার জন্য,
  • আর কারো মতে এই প্রশ্নই মূল্যহীন।

কিন্তু উপলব্ধির জায়গা থেকে আমরা বলতে পারিঃ

জগৎ সৃষ্টি হয়েছে যেন আপনি জানতে পারেন, কে আপনি। আর আপনি জানতে পারলেই বুঝবেন, ইশ্বর কে।

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon