মানুষ জন্মগতভাবে কৌতূহলী প্রাণী। ধর্ম আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়, আবার কিছু প্রশ্নের সামনে এসে আমরা থমকে দাঁড়াই। এই লেখায় আমরা ১০ টি বহুল আলোচিত ধর্মীয় প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও দার্শনিক বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করবো।
আল্লাহ বা ঈশ্বর কেন মানুষ সৃষ্টি করলেন?
একজন পরিপূর্ণ স্রষ্টা কেন সৃষ্টি করলেন? যুক্তিবাদী ব্যাখ্যায় বলা যায় “চেতনার স্বভাবই হচ্ছে প্রকাশ।” যেমন কবি কবিতা লেখে, শিল্পী ছবি আঁকে, ঠিক তেমনই একজন সর্বশক্তিমান স্রষ্টার প্রকাশ ঘটেছে সৃষ্টি জগতে। একে বলা যায় “আত্ম-প্রকাশের খেলা” (বা লীলা)। এখানে স্রষ্টা নিজের মহিমা অনুভব করতে চেয়েছেন সীমাহীন রূপে সেই রূপ একেকটা প্রাণ, একেকটা ভাবনার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে।
জগতের সত্যিকারের উদ্দেশ্য কী?
বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় “জগৎ হঠাৎ করেই বিগ ব্যাং থেকে সৃষ্টি হয়েছে।” কিন্তু ধর্ম বলে এর পেছনে এক সত্ত্বা আছে। যুক্তিগতভাবে বললে, এই বিশ্ব হচ্ছে একটি জটিল প্রোগ্রাম, যার প্রতিটি কোড নিখুঁতভাবে লেখা। উদ্দেশ্য? চেতনার বিকাশ। আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষিত হচ্ছি সত্য, মিথ্যা, ভালোবাসা, লোভ, আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে। তাই বিশ্ব একটি “বর্ণময় পরীক্ষাগার”, যেখানে প্রতিটি জীব তার আত্মা বিকাশের পথে হাঁটে।
মানুষের “ইচ্ছাশক্তি” আসলেই স্বাধীন, না কি পূর্বনির্ধারিত?
যুক্তিবাদীরা বলেন, আমাদের বর্তমান সিদ্ধান্তগুলো নির্ভর করে পূর্বের অভিজ্ঞতা, পরিবেশ ও মানসিক কাঠামোর উপর। অর্থাৎ, আমরা “সীমিত স্বাধীন”। ধর্মের ভাষায় ঈশ্বর জানেন আমরা কী করবো, কিন্তু তিনি জোর করে করান না। এটি এমন এক সফটওয়্যারের মতো, যেখানে সব সম্ভাবনা লেখা আছে, কিন্তু কোনটা চলবে তা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর সিদ্ধান্তে।
পাপ-পুণ্যের বিনিময়ে সুখ-দুঃখ কেন আসে?
এ প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায় সবাই হয়। যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে, পৃথিবী একটি নৈতিক পরীক্ষার মঞ্চ। একজন ভালো মানুষ কষ্ট পেতে পারে কারণ তার কষ্ট তাকে আরও গভীর, সহানুভূতিশীল ও শক্তিশালী করে তোলে। আর অনেক সময় এটা পূর্বজন্মের কর্মফলের ধারাবাহিকতাও হতে পারে যা হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে বলা হয় “কর্মফল”। ইসলামেও আছে “দুনিয়া মুমিনের জন্য কারাগার, কাফিরের জন্য জান্নাত।” অর্থাৎ, চূড়ান্ত ন্যায়বিচার দুনিয়ায় নয়, পরকালে হবে।
পৃথিবীতে এত দুঃখ-দুর্দশা ও অন্যায় থাকতে দেয়া হয় কেন?
যুক্তিবাদী ব্যাখ্যায়, পৃথিবীতে দুঃখ থাকার কারণ হলো বিকল্প ও পছন্দের স্বাধীনতা। যদি দুঃখ না থাকত, তাহলে ভালো থাকাকেও কেউ চিনতো না। নৈতিক বিকাশের জন্য কষ্ট প্রয়োজন, যেমন ব্যথা না থাকলে আমরা বুঝতাম না শরীরের কোথায় সমস্যা। আর স্রষ্টা যদি প্রতিটি অন্যায় সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করতেন, তবে মানুষ ‘রোবট’ হয়ে যেতো, নৈতিক উন্নতির সুযোগ থাকতো না।
মৃত্যুর পর কী হয়?
এই প্রশ্নে যুক্তিবাদীরা কয়েকভাবে উত্তর দেয়:
- বস্তুবাদীরা বলেন মৃত্যু মানেই সব শেষ।
- ধর্ম বলে আত্মা অমর। যুক্তিপূর্ণ ধারণা হলো, চেতনা একটি পৃথক শক্তি, যা দেহ-মস্তিষ্কের বাইরে টিকে থাকতে পারে। এর ইঙ্গিত আধুনিক Near Death Experience গবেষণাতেও পাওয়া গেছে।
যদি চেতনা কেবল পদার্থ না হয়, তবে তা দেহ মরে যাওয়ার পরও টিকে থাকতে পারে। ধর্মগুলো এই চেতনাকে আত্মা বলে এবং মৃত্যুর পর তার পরবর্তী গন্তব্য নির্ভর করে তার নৈতিক ভারসাম্যের উপর।
বিভিন্ন ধর্মের পরস্পরবিরোধী দাবির মধ্যে কোনটা সত্য?
যুক্তিবাদীরা বলেন “সব ধর্মই একটি মূল চেতনা থেকে জন্ম নিয়েছে ভালোবাসা, ন্যায় ও আত্মবিকাশ।” কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেক ধর্মীয় রীতিনীতি বা ব্যাখা বিকৃত হয়েছে। তাই ‘ধর্ম’কে বাইরের রূপে নয়, মূল চেতনায় বিচার করতে হবে। সত্য ধর্ম হবে সেই, যা মানবতার কল্যাণে কাজ করে এবং যে সত্যিকে ভয় না পেয়ে খোঁজার সাহস দেয়। তাই একমাত্র ‘নিজের অভিজ্ঞতা’ ও যুক্তি দিয়েই ধর্মীয় সত্য যাচাই করতে হবে।
আল্লাহ বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব কি প্রমাণ করা সম্ভব?
বিজ্ঞানের অনেক কিছুই বিশ্বাসের উপর দাঁড়ায় যেমন, মাল্টিভার্স বা ডার্ক ম্যাটার। ঠিক তেমনই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সরাসরি প্রমাণ করা না গেলেও, নানা যুক্তিতে তা অনুভব করা যায়:
- নৈপুণ্য যুক্তি (Design Argument): বিশ্ব এত নিখুঁতভাবে গঠিত যে এটা হঠাৎ তৈরি হতে পারে না।
- নৈতিক যুক্তি: মানবজাতির মধ্যে ন্যায়বোধ কোথা থেকে এলো?
- চেতনার যুক্তি: বস্তু কখনো চেতনা সৃষ্টি করতে পারে না, তাহলে আমাদের চেতনা কোথা থেকে এলো?
এগুলো সরাসরি প্রমাণ নয়, কিন্তু ‘যুক্তিনির্ভর বিশ্বাস’ (Rational Faith) তৈরি করে।
দোয়ায করলে আসলেই ভাগ্য পরিবর্তন হয় কি?
দোয়া কি বাস্তব? যুক্তিবাদীরা বলেন দোয়া মানে হচ্ছে নিজের ভিতরকার শক্তিকে সক্রিয় করা। আপনি যখন মন থেকে দোয়া করেন, তখন আপনার মন-দেহ-চেতনায় একটি বিশেষ শক্তির সঞ্চার ঘটে যা বাস্তবতার গতিপথকেও প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া, কোয়ান্টাম থিওরির ব্যাখ্যাও বলে চেতনার প্রভাবে বাস্তবতা পরিবর্তিত হতে পারে। তাই, দোয়া শুধু আবেগ নয় এটা এক ধরণের চেতনাসম্পন্ন কমান্ড।
শয়তানকে সৃষ্টি করা হলো কেন?
ধর্ম বলে, শয়তান এক সময়ের সৎ সত্তা ছিলেন, যিনি অহংকারে পতিত হন। কিন্তু যুক্তিবাদী বিশ্লেষণে শয়তান প্রতীক আমাদের ভেতরের অন্ধকার প্রবৃত্তির। এই অন্ধকার না থাকলে আলোও মূল্যহীন হতো। স্রষ্টা যদি শুধু ভালো সৃষ্টি করতেন, তবে কোনো নৈতিক বিকাশ হতো না। আর শয়তান প্রমাণ করে স্রষ্টা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধেও যাওয়ার। এই স্বাধীনতাই আমাদের মানুষের মতো করে তোলে রোবট নয়।
শেষকথা
এই প্রশ্নগুলো সহজ নয়। এগুলোর উত্তর একেক জন একেকভাবে খুঁজে পান; কেউ ধর্মগ্রন্থে, কেউ দার্শনিক চিন্তায়, আর কেউ নিজের অভিজ্ঞতায়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রশ্ন করা, চিন্তা করা, যুক্তির আলোয় নিজের বিশ্বাসকে যাচাই করা। স্রষ্টা যদি সত্যিই পরম সত্য হন, তবে তিনি প্রশ্নকে ভয় পান না বরং ভালোবাসেন।