শাপুলের ঈদ

সকালের সূর্য যেন ঈদের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশ জুড়ে। পাখির কলরবে চারপাশ গুঞ্জরিত, বাতাসে লেগে আছে নতুন কাপড়ের সুবাস, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে সেমাই এর গন্ধ। শাপুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নতুন পাঞ্জাবিটা একবার দেখল। ছেলের দেওয়া ঈদ উপহার। ছেলে আফসোস করে বলেছিল,


— “তুমি তো প্রতি বছর নামাজ পড়তে যাও, এবার যাবে তো?”
— “অবশ্যই যাব বাবা! ঈদের নামাজ তো আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।”

শাপুলের মন ভালো ছিল। যদিও গ্রামের লোকেরা তাকে সহজভাবে নেয় না, তবু সে চেষ্টা করে সবার সঙ্গে ভালো থাকতে। এবার সে ঈদের নামাজ পড়তে যাবে, সবাই মিলে একসঙ্গে মহান আল্লাহর দরবারে মাথা নত করবে; এটাই তো ঈদের মূল শিক্ষা!

শাপুল মাঠে পৌঁছাতেই খেয়াল করল, আশপাশের কয়েকজন তাকে দেখে ফিসফিস শুরু করল। কয়েকজন আবার তার দিকে তাকিয়েও রইল। সাধারণত ঈদের দিন এসব হয় না। সে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলেও পাত্তা দিল না। সে জায়গা খুঁজে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল।

মাঠের মাঝখান থেকে হঠাৎ কজন এগিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। গ্রামের প্রভাবশালী মাতব্বর খালেক চাচা কড়া গলায় বললেন,
— “শাপুল, তুই এই নামাজে দাঁড়াবি না।”

শাপুল থমকে গেল। তার মুখে বিস্ময়ের ছাপ।
— “কিন্তু কেন চাচা?”

একজন তরুণ বলল,
— “তুই জানিস না? গ্রামপ্রধান তোকে নিষেধ করেছে। তারপরও তুই আমাদের সাথেই নামাজ পড়বি?”

শাপুল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।
— “কিন্তু আমি কী করেছি?”

মাঝখান থেকে একজন বলে উঠল,
— “ওর মতলব ভালো না, ও ভালো লোক না। ওর সাথে আমরা নামাজ পড়তে পারব না!”

শাপুল এবার রাগ সংবরণ করতে পারল না। সে কাঁপা গলায় বলল,
— “আপনারা কি জানেন ঈদের নামাজের অর্থ কী? এটা তো আল্লাহর ইবাদত, এখানে বিভেদ কেন?”

কিন্তু কেউ শুনল না। নামাজ শুরু হতে যাচ্ছে, চারপাশের ফিসফাস থেমে গেছে। সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গেছে, অথচ শাপুল একা দাঁড়িয়ে রইল। তার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না।

বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। সে ধীরে ধীরে পেছনে হাঁটতে শুরু করল। পেছনে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে আগে জানালেই আমি অন্য গ্রামে গিয়ে নামাজ পড়তাম।”

নিঃসঙ্গ মনে শাপুল বাড়ির পথে হাঁটতে লাগল। ঈদ মানে কি কেবল বাহ্যিক উৎসব? যদি তাই হতো, তবে আজ সে এমন নিঃসঙ্গ কেন? সে কি এতটাই অযোগ্য যে, ঈদের দিনও কেউ তাকে জায়গা দিল না?

সে বাড়িতে ফিরে গেল। তার স্ত্রী কিছু বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন,
— “এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে কেন?”

শাপুল কিছু বলল না। তার স্ত্রী বুঝলেন, কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন না।

শাপুল সারাদিন কারও সাথে সে তেমন কথা বলল না। বিকেলে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো।

দরজা খুলতেই দেখা গেল বেশ কিছু তরুণ দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে কয়েকজন সকালে ঈদের নামাজে ছিল। একজন বলল,
— “ভাই, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। ঈদ মানে একতা, আর আমরা সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাকে আমরা জোর করে দূরে সরিয়ে দিয়েছি, কিন্তু এটা কি ঠিক হয়েছে আমাদের?”

শাপুল তাদের দিকে তাকাল। অন্য একজন বলল,
— “গ্রামের বড়রা নিজেদের স্বার্থের জন্য অনেক সময় অন্যায় সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু আমরা সেটা মানতে চাই না। আমরা চাই, সবাই একসাথে থাকুক।”

শাপুল অবাক হলো। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে গেল।
— “তাহলে? এখন কী করবে তোমরা?”

— “পরের বছর থেকে আমরা সবাই একসাথে ঈদের নামাজ পড়ব, ইনশাআল্লাহ। তুমি আমাদের সাথে থাকবে?”

শাপুলের চোখে জল এসে গেল। এই প্রথম ঈদের দিন তার মনে সত্যিকারের আনন্দের অনুভূতি এলো। সে মাথা নেড়ে বলল,
— “হ্যাঁ, আমি থাকব। আমরা সবাই একসাথে ঈদের নামজ পড়বো।”

সেই দিন থেকেই গ্রামের এক নতুন পরিবর্তনের শুরু হলো। ঈদের আনন্দ ফিরিয়ে আনল একতা আর ভালোবাসা।

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon