শুক্রবারের রক্তাক্ত বিকেল

উত্তর পাড়ার আকাশজুড়ে শান্ত নীল রং, বাতাসে হালকা দোল খাচ্ছে তালগাছের পাতারা। গ্রামের পুরুষেরা ধীরে ধীরে মধ্যপাড়া জামে মসজিদের দিকে এগোচ্ছে। আজ শুক্রবার সপ্তাহের সবচেয়ে পবিত্র দিন।

যিনি দীর্ঘদিন ধরে মসজিদের মুয়াজ্জিন, আজান শেষ করে ইমামের পাশে বসেছেন। তাঁর কণ্ঠে যেন বাতাসে একপ্রকার স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল। ঝড়-বাদল উপেক্ষা করেও তিনি প্রতিদিন আজান দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ছেলেরা ততটা ধার্মিক নয়, তারা কেবল শুক্রবারে মসজিদে আসে। অন্যদিকে হাজী সাহেব, এখনো হজ্জ না করলেও পরিবারকে তিনি শিক্ষিত ও ধর্মপরায়ণ করে তুলেছেন।

আজকের জুম্মার খুতবাটি ছিল ন্যায়বিচার ও ধৈর্যের শিক্ষা নিয়ে। ইমাম কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন, অন্যের সম্পদ নিয়ে অন্যায় করা হারাম, ক্ষমাশীল হওয়া উত্তম গুণ, আর ধৈর্য হারালে বিপদ আসতে বাধ্য। প্রতিটি মানুষ নিবিষ্ট মনে শুনছিল।

নামাজের শেষ রাকাতে যখন সবাই শান্তচিত্তে দাঁড়িয়ে, তখন হঠাৎ মসজিদের পেছন দিক থেকে এক চিৎকার,

“হায় আল্লাহ! বড় ভাইকে মেরে ফেলবে ওরা!”

এক মুহূর্তে যেন পুরো মসজিদটা কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ আগেও যারা বিনীতভাবে নামাজ পড়ছিল, তারা হতভম্ব হয়ে গেল। কয়েকজন নামাজ শেষ করার আগেই বেরিয়ে ছুটল, বাকিরা দোটানায় পড়ে গেল; নামাজ শেষ করবে, না ছুটে যাবে?

মুয়াজ্জিন ও হাজী সাহেব দুজনেই শঙ্কিত চোখে একে অপরের দিকে তাকালেন। তারা জানতেন, এই চিৎকারের অর্থ কী। বহুদিনের জমি সংক্রান্ত বিরোধ আজ চূড়ান্ত সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে!

মসজিদ থেকে বেরিয়ে সবাই ছুটে গেল মাঠের দিকে। সেখানে যা দেখল, তা যেন এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন।

দুই পক্ষের লোকজন লাঠি, বল্লম হাতে একে অপরের দিকে তেড়ে যাচ্ছে। কারও মাথায় রক্ত, কেউ মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। জমির দখল নিয়ে কথা কাটাকাটি একসময় হাতাহাতিতে গিয়েছে, আর এখন রক্ত ঝরছে!

মুয়াজ্জিনের বড় ছেলে করিম মাটিতে পড়ে আছে, কপাল ফেটে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। হাজী সাহেব এর ছেলে ফারুক হাতে লাঠি ধরে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে ঘৃণা আর উত্তেজনার মিশ্র ছাপ।

হাজী সাহেব ছুটে গিয়ে ফারুকের হাত ধরলেন, মুয়াজ্জিন করিমকে কোলে তুলে নিলেন। কিন্তু দুই পক্ষের অন্য লোকজন তখনো মারামারি চালিয়ে যাচ্ছে।

ঠিক তখনই মাঠের মাঝখানে এসে দাঁড়াল হাজী সাহেব এর সাত বছরের নাতি হাফিজ। ছেলেটা কাঁপা গলায় চিৎকার করে বলল,

“আব্বা! দাদা! আপনারাই তো বলেন, ইসলাম মানুষকে শান্তি শেখায়। তাহলে আপনারা কেন মারামারি করছেন?”

তার কচি কণ্ঠ যেন বজ্রপাতের মতো আঘাত হানল।

এক মুহূর্তের জন্য সব থেমে গেল। যাদের হাতে লাঠি ছিল, তাদের হাত কাঁপতে লাগল। মাটিতে পড়ে থাকা করিমের মুখের যন্ত্রণা যেন হঠাৎ করেই বদলে গেল। হাজী সাহেব হতভম্ব হয়ে নাতির দিকে তাকালেন। মুয়াজ্জিন মাথা নিচু করে ফেললেন।

চারপাশে দাঁড়ানো মানুষেরা ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠল। একটু আগে যারা একে অপরকে শত্রু মনে করছিল, তারা যেন নিজেদের প্রতিফলন দেখতে পেল শিশুটির চোখে।

হঠাৎ করেই মসজিদের মাইক থেকে ধীর, অথচ দৃঢ় কণ্ঠে ভেসে এল,

“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার!”

মুয়াজ্জিন নিজের কষ্ট ভুলে গিয়ে আজানের ধ্বনি ত্যাগ করেননি। তাঁর কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু সেই ধ্বনি যেন আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিল।

ইমাম সাহেব ছুটে এলেন। কাঁপা গলায় বললেন,

“আজ যদি এই জমির জন্য কেউ মরে যেত, তাহলে কি কবরস্থানে গিয়ে এই জমি দাবি করতে পারতেন?”

শুনেই অনেকে মাথা নিচু করে ফেলল। লজ্জায়, অনুশোচনায়, অপরাধবোধে।

সেদিনের সেই রক্তাক্ত বিকেল বদলে দিল গোটা গ্রামকে।

পরের শুক্রবার, মসজিদের খুতবায় ইমাম ঘোষণা দিলেন,

“আজ আমরা শপথ করি, জমির জন্য রক্ত নয়, ন্যায়বিচার চাই। ধর্ম শুধু নামাজের জন্য নয়, মানুষের সঙ্গে ন্যায়বিচার করাও ধর্মের অংশ।”

গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, জমি নিয়ে আর কোনো ঝগড়া চলবে না। দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য বিচার ব্যবস্থা করা হলো। মুয়াজ্জিন ও ইউ হাজী সাহেবনুস একসঙ্গে বসে কোরআনের ব্যাখ্যা শুনলেন।

শিশু হাফিজের সেই ছোট্ট প্রশ্ন, এক বিকেলের রক্তপাতকে পরিণত করল একটি নতুন জাগরণে।

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon