মন্দিরার ছন্দপতন

রমজান মাস। এক বছর আগেও রাইফ ছিল অন্য এক জগতে, সুরের মধ্যে, মন্দিরার ছন্দে, গানের দলে। তখন সে নিজেকে খুঁজে পেত সুরের ভেতরে, অথচ সবাই তাকে আখ্যা দিয়েছিল পাগল। সময় বদলে গেছে। এই রমজানে সে আর সেই গানের দলে নেই। গানের দলও আর আগের মত নেই।

ভোকাল চুল কেটে ফেলেছে, নতুন জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে; তার কণ্ঠে আগের সেই আবেগ নেই। বেজ বাদক গানের দল ছাড়তে চায়, দোতারা বাদক দীর্ঘদিন পিক না থাকায় গানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, হারমোনিকা বাদক কেবল বসে থাকে। কাহন বাদক অনেক চেষ্টা করেও কাউকে গানের পথে নিয়ে আসতে পারেনি। বাঁশি বাদক ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমতি হারিয়েছে, অথচ তার বাঁশির সুর ছিল পরিবহন মার্কেটের প্রাণ।

বায়া বাদক সবার দিকে তাকিয়ে ভাবে, সবকিছু এত অশান্ত কেন? গান তো আত্মার ভাষা, তা কি এত সহজেই নির্বাক হয়ে যেতে পারে? তার মনে প্রশ্ন জাগে, এই যে এত মানুষ গানের আসরে আসে, বসে, গান শোনে, এদের আত্মাগুলো কি সত্যিই শান্ত? সে দেখে, তাদের মধ্যে কেউ চিৎকার করছে, কেউ গালিগালাজ করছে, কেউ নেশা করছে, আবার কেউ কেবলই বসে আছে, তাকিয়ে আছে শূন্যতার দিকে।

অনেকের মধ্যে পরিবর্তনও এসেছে। কিছু আত্মা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে, তাদের অনুশোচনা জন্ম নিয়েছে। তারা নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছে যে তারা আর খারাপ পথে হাঁটবে না। কিছু আত্মা শিখছে কিভাবে রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তারা জীব থেকে মানুষ হওয়ার পথে এগোচ্ছে।

রমজান মাসের প্রতিটি রাত রাইফের ভেতর এক নতুন উপলব্ধি জাগিয়ে তোলে। সে বুঝতে পারে, সুর কেবল বিনোদন নয়, এটি আত্মার আহ্বান। যে আত্মা সুরের গভীরে ডুব দিতে পারে, সেই আত্মাই সত্যিকারের প্রশান্তি খুঁজে পায়।

একদিন, দলের বেজ বাদক রাইফকে দেখতে আসে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তুই কি মনে করিস গান আসলেই বদলে দিতে পারে মানুষকে? আমি আর অনুভব করি না আগের মতো। গান এখন কেবল একটা শব্দ মনে হয়।” রাইফ কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর বলে, “গান শব্দ না, এটা আত্মার অনুভূতি। আপনি যদি কান দিয়ে না শুনে মন দিয়ে শুনতে পারেন, তবেই বুঝবেন।”

এমন কথার পরও বেজ বাদক আশ্বস্ত হয় না। সে বলে, “এই দুনিয়ায় কেউ কি সত্যি শুনতে চায়?” রাইফ কিছু বলে না, শুধু মন্দিরা বাজায়। বেজ বাদক কিছুক্ষণ চুপ থেকে উঠে চলে যায়। কিন্তু তার ভেতরে যেন একটা কিছু নড়ে যায়।

বাঁশি বাদক, যে এখন আর ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারে না, লুকিয়ে এক রাতে রাইফের সাথে দেখা করতে আসে। সে বলে, “আমার বাঁশি বাজানোর জায়গা ছিল ক্যাম্পাসের পরিবহন মার্কেট। এখন সেখানে আমাকে দেখলে অনেকেই সন্দেহের চোখে তাকায়। আমি কিছুই করিনি, কিন্তু তারা ভাবে আমি বিপজ্জনক। আমি আর কোথায় বাজাবো বল?”

রাইফ গভীর দৃষ্টিতে তাকে দেখে। সে বলে, “আপনার বাঁশি আপনাকে কোথাও না কোথাও নিয়ে যাবে একদিন। হয়তো এমন একটা জায়গায় যেখানে সত্যিকারের সুর শোনা যাবে। কিন্তু তার আগে আপনার নিজের ভেতরের সুরটা আপনাকে খুঁজে পেতে হবে।”

বাঁশি বাদক মাথা নিচু করে বসে থাকে। অনেকক্ষণ পর সে বলে, “আমি তো বাজিয়েই যাচ্ছি, কিন্তু আমার নিজেরই তো বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।

একদিন, রাইফ সিদ্ধান্ত নেয় সবাইকে একত্রিত করবে। সে গোপনে তাদেরকে ডাকে। গানের আসরে আবার সবাই জড়ো হয়। বেজ বাদক, দোতারা বাদক, হারমোনিকা বাদক, বাঁশি বাদক, সবাই আসে। ভোকালও আসে, যদিও আগের মত গাইতে পারে না।

রাইফ বলে, “আমরা সবাই বদলে গেছি। কিন্তু গান কি বদলেছে? আমরা গান ছেড়েছি, গান আমাদেরকে ছাড়েনি। আমরা কি আরেকবার চেষ্টা করতে পারি?”

কেউ কিছু বলে না। কিছুক্ষণ পর দোতারা বাদক তার দোতারা বের করে, অনেকদিন পর দোতারার সাথে আজ সে পিক নিয়ে এসেছে। হারমোনিকা বাদক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হারমোনিকা বাজাতে শুরু করে। বাঁশি বাদক একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বাঁশিতে ফুঁ দেয়।

ধীরে ধীরে সেই পুরনো সুর ফিরে আসে।

এই সুর এক নতুন আহ্বান, এক নতুন শুরু। সবাই বুঝতে পারে, গান কেবল বিনোদন নয়, এটি আত্মার মুক্তি। রমজানের এই রাত সেই সত্যের সাক্ষী হয়।

তারা অনুভব করে, প্রতিটি আত্মা এক সময় পথ হারায়, কিন্তু যদি সত্যিকারের সুর খুঁজে পায়, তবে সে আবার পথ খুঁজে নিতে পারে। গান শুধু কণ্ঠের বা বাদনের বিষয় নয়, এটা আত্মার প্রকাশ এবং এই উপলব্ধি তাদের নতুন এক যাত্রার সূচনা করে।

রাইফ জানে, এই পথ সহজ নয়। কিন্তু সে অনুভব করে, যদি তারা একসাথে থাকে, যদি তারা সত্যিকারের সুরের দিকে এগিয়ে যায়, তবে তারা আত্মার শান্তি খুঁজে পাবে।

গানের দল নতুন রূপে ফিরে আসে। তবে এবার শুধু বিনোদনের জন্য নয়, আত্মার মুক্তির জন্য!

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon