জীবনের মানে আটশো কোটি

কড়ইগাছের নিচে গানের রেওয়াজ শেষ হতে হতে রাত দশটা। সবাই উঠে গেলে ব্যাগের মধ্যে মন্দিরা আর হাতবায়া ঢুকিয়ে আমি, রাফি, রাইফ আর আকিফ রওনা দিলাম পরিবহন মার্কেটের দিকে। আড্ডার গন্ধ ভেসে আসছিল দূর থেকেই। গানের রেশ আর আংশিক আলোয় আলোকিত মুখগুলো যেন লুকোচুরি খেলছে নিজের স্বত্বার সাথেই।

পরিবহন মার্কেট ইউনিভার্সিটির প্রাণকেন্দ্র। প্রশাসন ভবনের পাশেই এর অবস্থান। এখানেই কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, আর সামনে চায়ের দোকানগুলো। শত শত শিক্ষার্থীর আড্ডার জায়গা এটা। কেউ গিটার বাজায়, কেউ প্রেম করে, কেউ চা খায়, কেউ শুধু বসে থাকে নীরব হয়ে। এই পরিবহন মার্কেট দেখেছে অনেক ভালোবাসা জন্ম নিতে, আবার হারিয়ে যেতেও।

রুমি বসে ইউকেলেলে বাজাচ্ছে, দারুণ মিষ্টি সুর। পাশে দূর্যয় (চক্রবর্তী) গানের মধ্যে ডুবে থাকা ছেলেটা, যার গলায় এমন অদ্ভুত এক দরদ আছে যা শুনলে হৃদয় কেঁপে উঠে। আরেক পাশে দূর্যয় (ঢুলি) এবং রিমন খমক বাজিয়ে তাল দিচ্ছে। আরো কিছু চেনা-অচেনা মুখ বসে আছে। সবার চোখে এক ধরনের প্রশান্তি।

আমি গিয়ে চুপচাপ বসলাম ওদের পাশে। “বসেন ভাই। মন্দিরাটা ধরেন, একটা গান করি” বলেই ঢোলে বাড়ি দিল দুর্জয়।

ফকির লালন এর একটা গান ধরলো দূর্যয়,

“আমার মত প্রাণ কাঁদিলে,
বুঝবি রে গৌর প্রেমের কালে”

তার কণ্ঠে ছিল গৌর-নিতাই এর গভীর প্রেম। আমি মন্দিরা বাজিয়ে যাচ্ছি স্রোতের মতো। সময় যেন থেমে গেল। মনে হলো, এই মুহূর্তটাই জীবনের সবচেয়ে স্পষ্ট সত্য।

গান শেষে হঠাৎ দূর্যয় বলল, “ভাই, আপনার কাছে জীবন মানে কী?”

আমি একটু চমকে গেলাম। প্রশ্নটা হাওয়ার মতো এলেও, ওজন ছিল পাহাড়ের মতো। সবাই বাজানোর মধ্যে বিভোর তখনো।

আমি তাকিয়ে বললাম, “জীবনের মানে একেকজনের কাছে একেকরকম। দুনিয়ায় আটশো কোটি মানুষ, আটশো কোটি জীবন, আটশো কোটি রকম। কারো কাছ, জীবনের মানে ভালোবাসা, কারো কাছে সেবা করা। কেউ সৃষ্টির মধ্যে জীবনের মানে খোঁজে। কেউ সন্তানের হাসিতে, কেউ খেলার মাঠে, কেউ আবার গানের মধ্যে জীবনের মানে খোঁজে।”

দূর্যয়ের চোখ চকচক করে উঠলো।
সে আবার জিজ্ঞেস করল, “মানুষ তাহলে হতাশায় ডুবে কেন?”

আমি বললাম, “কারণ সে থাকে না বর্তমান মুহূর্তে। চিন্তা করে কী হতো যদি… অথবা কী হবে যদি… অতীত বা ভবিষ্যৎ তাকে আঁকড়ে ধরে থাকে। অথচ এই মুহূর্তটাই তার জীবন। অথচ কেউ ধ্যান জানলে সে বুঝতে পারবে যে চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।”

রাফি পাশে বসে বলল, “ঠিকই বলেছেন ভাই, এই কথাটা আমি নিজের মধ্যে অনুভব করেছি।”

আকিফ একটু মাথা চুলকে বলল, “আপনি বললেন জীবনের মানে প্রত্যেকের আলাদা। কিন্তু আমরা যদি জানতেই না পারি জীবন আসলে কী, তাহলে তো নিজে ঠিক করে বুঝতেও পারি না যে আমরা কোথায় যাচ্ছি। সেটা তো আর কল্পনার ওপর নির্ভর করে ঠিক করা যায় না, তাই না?”

আমি একটু চুপ করলাম। একটা সিগারেট ধরালাম।

আমি বললাম, “জীবন মানে হলো ‘এই মুহূর্ত’। আর ধ্যান মানে এই মুহূর্তের মধ্যে ডুবে যাওয়া। না অতীত, না ভবিষ্যৎ। শুধু ‘এই মুহূর্ত’। কারণ হতাশা আসে যখন আমরা অতীতে বাস করি, আর ভয় আসে যখন আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি।”

রিমন খমকে একটা তাল বাজাতে বাজাতে বলল, “তাহলে কি ভাই, ভবিষ্যতের চিন্তা একদম না করাই ভালো?”

আমি মাথা নাড়লাম। “না, ভবিষ্যৎ ভাবা যায়। কিন্তু সেই ভাবনায় নিজের বর্তমান নষ্ট না করে। তোমরা গান কর, না? গান গাওয়ার সময় তোমরা কি ভাবো যে গান শেষে কে কী বলবে? নাকি সেই সময়টুকু তালের মধ্যে বাঁচ?”

রাফি বলল, “তালের মধ্যে বাঁচি ভাই।”

আমি হেসে বললাম, “এটাই তো জীবন, মুহূর্তে বাঁচা।”

রুমি চুপ করে ছিল, এবার বলল, “ভাই, মাঝে মাঝে মনে হয়, সব কিছু করেও একটা শূন্যতা থেকে যায়। গান গাই, বন্ধুদের সাথে থাকি, পড়াশোনাও করি… কিন্তু কোথায় যেন ফাঁকা লাগে।”

আমি তাকালাম রুমির চোখের দিকে। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু আশাও আছে।

“এই ফাঁকাটাই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই শূন্যতা না থাকলে মানুষ কখনো সত্যি খুঁজত না। ঠিক এই জায়গা থেকেই শুরু হয় খোঁজ। তুমি যেদিন সব কিছুতেই পূর্ণতা পেয়ে যাবে, সেদিন তোমার জীবন থেমে যাবে।”

দূর্যয় (ঢুলি) একটু ঘাড় চুলকে বলল, “ভাই, আপনি বললেন জীবন এর মানে সবার আলাদা আলাদা। কিন্তু কিছু তো মিল থাকে, তাই না? কিছু জিনিস তো সবারই এক রকম…”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, থাকে। যেমন সবাই চায় সুখ, শান্তি, ভালোবাসা। কিন্তু সেই চাওয়া পূরণ করার রাস্তা একেকজনের আলাদা। কেউ পায় টাকায়, কেউ পায় গানে, কেউ খোঁজে নির্জনতায়।”

রাইফ বলল, “আর কেউ খোঁজে ধ্যানে।”

আমি মাথা নাড়লাম, “ঠিক বলেছ। আর কেউ খোঁজে একটা মানুষের মধ্যে; ভাবে, এই মানুষটা থাকলেই আমার জীবন সম্পূর্ণ।”

আকিফ বলল, “কিন্তু সেই মানুষ তো সব সময় আমাদের মতো ভাববে না।”

আমি বললাম, “তাই তো সম্পর্ক ভেঙে যায়। কারণ আমরা ভাবি, ‘সে আমাকে বোঝে না’। অথচ নিজেদেরও তো আমরা পুরোপুরি বুঝি না। তখনই হতাশা আসে। হতাশা মানে, আমি যা চেয়েছি সেটা পাইনি, এই ধারণা। কিন্তু জীবন তো একটা সিনেমার মতো, শেষ দৃশ্য না দেখে কেউ জানে না, গল্পটা আসলে কেমন।”

দূর্যয় (চক্রবর্তী) আস্তে বলল, “ভাই, তাহলে কি জীবন মানে শুধু অপেক্ষা?”

আমি বললাম, “না রে ভাই, জীবন মানে অপেক্ষা না। জীবন মানে পথচলা। কিন্তু সেই পথ যদি নিজের না হয়, তবে তুমি কখনোই ঠিক করে হাঁটতে পারবে না। অন্যের তৈরি মানে দিয়ে নিজের জীবন বোঝা যায় না। নিজেকে নিজেই জানতে হয়।”

রুমি হঠাৎ বলল, “ভাই, আপনি কি মনে করেন, জীবন আসলে কোনো অর্থ ছাড়া চলে?”

আমি বললাম, “তুমি কখনো ঘাসের ওপর পা রেখে হেঁটেছ? পাখির ডাক শুনে থেমে গেছ? কোনো গান শুনে কেঁদেছ? এইগুলোর পেছনে কোনো অর্থ খুঁজেছ?”

রুমি মাথা নাড়ল।

“এইগুলোই আসলে জীবন, যার মানে বোঝার দরকার হয় না, অনুভব করতে হয়।”

রাফি বলল, “তাহলে জীবন মানে অনুভব করা?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ। বাঁচার অনুভব, ভালোবাসার অনুভব, হারানোর অনুভব… সব মিলে এক রঙিন বৃত্ত।”

দূর্যয় (চক্রবর্তী) বলল, “ভাই, আপনি লেখবেন না এই কথাগুলো? জীবনের মানে নিয়ে একটা কিছু লেখেন ভাই।”

আমি বললাম, “তুমি বলেছ বলেই ভাবছি লিখে ফেলবো একদিন… এই সন্ধ্যামূখর গানের আড্ডা, এই আলো-ছায়ায় তোমাদের মুখ, আর জীবনের এত প্রশ্ন, এসব তো হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাব না।”

রিমন ধীরে বলল, “এই মুহূর্তটাই আসলে জীবন, তাই না ভাই?”

আমি বললাম, “এই যে বসে আছি সবাই মিলে, এই কথাগুলো বলছি, হাসছি, গান করছি, চিন্তা করছি… এইটুকুই তো আমাদের জীবনের মানে, এখনকার জন্য।”

রাত প্রায় এগারোটার দিকে গানের রেশ অনেকটা কমে এলেও আড্ডাটা চলছে নিজের ছন্দে।

ঠিক তখনই একটা নতুন মুখ এসে দাঁড়াল সামনে।

একটা পাতলা চাদর গায়ে, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, হাতে একটা পুরনো নোটবুক। বয়স বোঝা যাচ্ছে না, বিশের শেষ, নাকি ত্রিশের শুরু, বলা মুশকিল।

লোকটি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা কি জীবন নিয়ে কথা বলছিলেন?”

সবাই একদম চুপ।

আমি তাকিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, বসুন। আপনিও বলুন আপনার কাছে জীবন এর মানে কী?”

সে আস্তে আস্তে বসল আমাদের পাশে। মৃদু হাসল। তারপর বলল, “জীবন মানে সময়। আর সময় মানে চলে যাওয়া। আপনি কিছুই ধরে রাখতে পারবেন না। মানুষ, স্মৃতি, আনন্দ, দুঃখ সব চলে যায়।”

সবার চিন্তা থমকে গেল।

রুমি চুপ করে তাকিয়ে আছে। রিমন খমকটা পাশে রেখে হাঁ করে শুনছে।

আমি বললাম, “আপনি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন?”

সে মাথা নাড়ল, “না। আমি এখানে এসেছিলাম পুরনো কোনো কিছুর খোঁজে। এক সময় আমিও এখানে গান করতাম… এই জায়গায়। ওই কোণার চায়ের দোকানে বসে এক মেয়ে আমাকে বলেছিল ‘তুমি কি জানো? জীবন মানে গল্প।’ তখন আমি কিছু বলিনি। কিন্তু আজ বুঝি, সে ঠিকই বলেছিল।”

দূর্যয় (চক্রবর্তী) বলল, “আপনি এখনো গান করেন?”

“না। এখন শুধু শুনি।”

রাফি জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আপনি এখন কী করেন?”

সে বলল, “মানুষ দেখি। কারো মুখে ক্লান্তি, কারো গলায় হতাশা। কখনো চুপ করে বসে থাকি আর ভাবি, এরা আসলে কী খোঁজে?”

আমি বললাম, “আপনি আমাদের সবার প্রশ্নের মাঝে ঢুকে পড়েছেন।”

লোকটি হেসে বলল, “কারণ তোমরা খোঁজ করছো। জীবন তখনই গভীর হয়, যখন মানুষ প্রশ্ন করতে শেখে।”

আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে।

আমার মনে হলো, মানুষটা কোন বার্তা নিয়ে এসেছে, না সময় থেকে, না ভবিষ্যত থেকে, বরং আমাদের নিজেদের ভেতর থেকে।

আমি আস্তে আস্তে বললাম, “আপনার কথা শুনে মনে হলো, জীবনের মানে কখনো বোঝা যায় না, শুধু ছোঁয়া যায়।”

সে মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। আর সেই ছোঁয়া পেতে হলে… তোমাকে থামতে হবে। শুনতে হবে। দেখতে হবে। সব কিছু নয়, শুধু এই মুহূর্তটুকু।”

তারপর সে উঠে দাঁড়াল। বলল, “যাচ্ছি। আবার দেখা হবে।”

কেউ কিছু বলল না।

মানুষটা চলে গেল প্রশাসন ভবনের দিক ধরে, ধীরে ধীরে। যেন হেঁটে যাচ্ছে একটা অসমাপ্ত গানের দিকে।

সবাই চুপ।

রাফি তখন বলল, “ভাই… এই মানুষটা কে ছিল?”

আমি বললাম, “কেউ একজন, যে হয়তো আমাদেরই ভবিষ্যৎ।”

আমি হাতবায়া হাতে নিয়ে বললাম, “চল, আর একটা গান করি। জীবনের মানে বোঝা যাবে কি যাবে না, কে জানে! কিন্তু আমরা তো গান গাইতে পারি, তাই না?”

দূর্যয় (চক্রবর্তী) গান ধরল,

“ভরসা করি এ ভব কাণ্ডারী,
অবেলার বেলা পানে চাও চাও চাও রে”

রুমি ইউকেলেলেতে টোকা দিল, দুর্জয় ঢোলে তাল দিল, রিমন খমক হাতে নিল…

আমরা আবারো গানের গভীরে চলতে শুরু করলাম। জীবন একটার পর একটা প্রশ্ন রেখে তার নিজস্ব গতিতে বয়ে যায়, কিন্তু মাঝখানে থেকে যায় কিছু গান, কিছু কথা, কিছু সন্ধ্যা… যা হারায় না কোনোদিন।

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon