হঠাৎ করেই বাবু ভাইকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। শবনম অনেক খোঁজাখুজির পরও বাবু ভাইয়ের কোন হদিস না পেয়ে অবশেষে সুমন ভাইয়ের কাছে গেলেন। সুমন ভাই বাবু ভাইয়ের খুব কাছের একজন এবং ঠান্ডা মাথার মানুষ। তিনি অতি কৌশলে সত্য গোপন করে শবনমকে বললেন যে তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানেন না। এই ঘটনার পর শবনমের অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল এবং তিনি সন্ধ্যার আলো পত্রিকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি দিলেন।
শুক্রবার। শবনম এর কলেজ বন্ধ। তিনি একটি কলেজে ভূগোল পড়ান। কলেজের খাতা দেখতে হবে, বাবুকে (বাচ্চাকে) খাওয়াতে হবে, গোসল করাতে হবে। অথচ কোন কাজেই তার মন বসছে না। তিনি ফোন হাতে নিলেন। কন্ট্রাক্ট লিষ্ট এর সবাইকে এক এক করে ফোন দিতে শুরু করলেন। ফোন দিতে দিতে আবিষ্কার করলেন বাবু ভাই এবং রশ্নির নাম্বারে ফোন দিলে একই সিগনাল দেখাচ্ছে__ Out of Network। তিনি সুমন ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলেন রশ্নিকেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না এবং সুমন ভাই নিজেও জানেন না রশ্নি কোথায়।
এইবার শবনমের কিছুটা সন্দেহ হল। তিনি অনুমান করলেন বাবু ভাই এবং রশ্নি একসাথেই আছে। প্রায়ই রশ্নিকে বাবু ভাইয়ের গাড়িতে ঘুরতে দেখা যায়। তিনি দুঃশ্চিন্তায় রাত কাটালেন। পরদিন সকালে স্কুলে যাবার আগে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করলেন এবং বাবু ভাইয়ের কর্মস্থলে চিঠির মাধ্যমে লিখিত অভিযোগ জানালেন (এখানে উল্লেখ্য যে চিঠি দেয়ার সময় অনেকেই তাকে কান্নাকাটি করতে দেখেছে)।
অন্যদিকে প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর কাকভেজা হয়ে বাবু ভাই ছয়জনের একটা টীম নিয়ে রেমাক্রী থেকে নাফাখুম গিয়ে পৌছালেন। প্রত্যেকের ব্যাগের শুকনো জামা-কাপড় বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। কাকভেজা জামা-কাপড় ছেড়ে সবাই ব্যাগের মধ্যে থাকা আধভেজা জামা-কাপড় পড়ল। রুমে সবাই এলোমেলো। নাফাখুম জলপ্রপাত এর পাশেই কটেজ। চোখ বন্ধ করলে কটেজের রুম থেকেই জলপ্রপাত এর শব্দ শোনা যায়।
বিগত ছত্রিশ ঘন্টা যাবৎ সবাই গাড়িতেই ছিল। লাল রঙের মাজদা ছুটে চলছে বান্দরবানের উদ্দ্যেশ্যে। দিপ্ত স্পোর্টস মোডে ড্রাইভ করছে। নওসাদ গাড়িতে বসেই ব্ল্যাক লেবেল এর সাথে সিগারেট খাচ্ছে। পারিশা ফজরের কাজা নামাজ (কছর) পড়ছে। রশ্নি চোখ বন্ধ করে বসে আছে। নামাজ শেষে পারিশা নওসাদ এর হাত থেকে ব্ল্যাক লেবেল এর বোতল নিয়ে বেশ খানিকটা খেয়ে ফেলল এবং কিছুক্ষণ পর অজু না করেই যোহর এর নামাজ আদায় করল (পারিশার এই কার্যকলাপ দেখে প্রাথমিকভাবে পারিশাকে পাগল অথবা মানসিক রোগী মনে হতে পারে)। তবে নামাজ শেষ হতেই বাবু ভাই কথা বলতে শুরু করলেন এবং সবার মধ্যে বেশ কিছু স্বাভাবিক কথোপকথন হলঃ
- বাবু ভাইঃ রশ্নি, জেগে আছিস?
- রশ্নিঃ জ্বালায়েন না তো আর!
- বাবু ভাইঃ যদি বেঁচে থাকিস তাহলে বান্দরবান থেকে ফিরে অফিসে গিয়েই একটা কাজ করবি…
- রশ্নিঃ কি কাজ?
- বাবু ভাইঃ অফিসে তোর চেয়ারটা সরিয়ে ওইখানে একটা বাথটাব বসাবি।
- রশ্নিঃ অফিসে বাথটাব কি করব! আজব তো!
- বাবু ভাইঃ বাথটাবে লল্লি (গলা) পর্যন্ত ডুবিয়ে অফিস করবি। পানির মধ্যে শরীর থাকবে ঠান্ডা। শরীর ঠান্ডা থাকলে মাথা থাকবে বরফের মত শীতল।
- দিপ্তঃ রশ্নি আপুর মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা। আপনি বরং নিজের মাথা ঠান্ডা করেন।
- বাবু ভাইঃ তুমি চুপ থাক তো ভাই। ফেরেস্তার মত বউ পেয়ে যা ইচ্ছা তাই করছ, না!
- দিপ্তঃ ছিঃ ছিঃ। আমি কি খারাপ মানুষ ভাই?
- বাবু ভাইঃ আরে নাহ্। আমাদের মত ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমরা বউ পিটাই না, মারামারি করি না, কাউকে গালি দেই না, কারো ক্ষতি করি না। করার মধ্যে কি আর করি__ কালে ভাদ্রে দুই চার পেগ খাই। কার জন্য খাই? বউয়ের জন্য। বউ যখন রাগ করে থাকে তখন বাধ্য হয়ে খাই। ঠিকই করি শালা।
- দিপ্তঃ সেটাই ভাই। এই কথাটাই আজ পর্যন্ত কাউকে বোঝাতে পারলাম না আমি।
- বাবু ভাইঃ পাগল নকি তুমি! কবেই বোঝানো ছেড়ে দিয়েছি আমি। ওরা কোনদিনই আমাদেরকে বোঝেনি, বুঝবেও না। বোঝানোর যেহেতু কোন শেষ নাই, বোঝানোর চেষ্টা বৃথা তাই।
- দিপ্তঃ সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। গাড়ি কি থামাবো ভাই? খাওয়া-দাওয়া সেরে নেয়া যায়।
রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামল। বাবু ভাই ছাড়া সবাই পরোটা আর ডিম ভাজি অর্ডার করল। বাবু ভাই অর্ডার করলেন ভূনা খিচুড়ি আর মাংস। খেতে বসে বাবু ভাইয়ের ফোন বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করেই বাবু ভাই দুই লাইন গান গাইলেন, “আমাকে ফেরানো যাবেনা, ফেরারি পাখিরা কুলে ফেরেনা…”। খেতে খেতে তিনি শবনম এর সাথে বেশ কিছুক্ষণ ফোনে কথা বললেন__
- বাবু ভাইঃ পরের বার ব্যাংকক গেলে তোমার জন্য একটা স্বর্নের মোবাইল হ্যাঙ্গার নিয়ে আসবো। মোবাইল গলায় ঝুলানো থাকলে সহজেই ফোন রিসিভ করতে পারবে। আচ্ছা, ফোন কেন রিসিভ করোনা তোমরা!
- শবনমঃ সাউন্ড শুনতে পাইনি। খেয়েছ তুমি?
- বাবু ভাইঃ খিচুড়ি খাচ্ছি। ভুতুম কেমন আছে?
- শবনমঃ তোমার ছেলে ভালোই আছে। আমার খোঁজ-খবর তো নিলেনা কোনদিন!
- বাবু ভাইঃ আমার নিজেরই কোন খোঁজ-খবর নাই। শোন, বেশ কয়েকদিন ব্যস্ত থাকবো আমি। ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে পূজার ছুটিতে শ্রীমঙ্গল যাব।
- শবনমঃ আগে ফিরে তো আসো, তারপর দেখা যাবে। ফোন রাখছি, তোমার ছেলে ঘুম থেকে উঠে গেছে।
খাবার শেষ করে রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে বাবু ভাই সিগারেট ধরাবে ঠিক এমন সময় একজন বয়স্ক মহিলা বাবু ভাইয়ের সামনে এসে হাত পেতে ভিক্ষা চাইলেন। বাবু ভাই নতুন প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট মহিলার হাতে দিয়ে বললেন, ” টাকা-পয়সা দিলে হয়ত পাঁচ-দশ টাকা দিতাম, ষোল টাকা দামের একটা সিগারেট দিলাম; এখন যা”। ভদ্রমহিলা রেগে গিয়ে সিগারেট ফেরত দিয়ে চলে গেলেন। রাগের কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে বাবু ভাই সিগারেট ধরালেন এবং সিগারেট শেষ হলে আবারো রওনা দিলেন নাফাখুম এর উদ্দ্যেশ্যে।
ত্রিপুরা পাড়া, নাফাখুম; বান্দরবান। ছত্রিশ ঘন্টা জার্নি শেষে বৃষ্টিতে ভিজে অন্ধকারের মধ্যে পাহাড়ি ট্রেইল ধরে প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর কাকভেজা হয়ে বাবু ভাই তার দল নিয়ে রেমাক্রী থেকে নাফাখুম গিয়ে পৌছালেন। তখন আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ঝুম বৃষ্টি। রুমের মধ্যে পোর্টেবল স্পিকারে গান বাজছে__ “আমার অঙ্গে অঙ্গে”। বাবু ভাই এলাচ এর বোতল হাতে বসে আছে। প্রান্ত ওয়ানটাইম প্লেটে গাঁজা নিয়ে কি একটা করছে। রশ্নি’র ফোনে ইন্টারনেট কানেকশন না থাকায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই শুয়ে শুয়ে সবার কথা শুনছে। দিপ্ত কমলা রঙের কম্বল মুড়ি দিয়ে শুকজয় (গাইড) এর সাথে কথা বলছে। পারিশা চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ বাবু ভাই শুকজয় এর দিকে তাকিয়ে বললেন__
- বাবু ভাইঃ শুকজয়…
- গাইডঃ জ্বী, বলেন।
- বাবু ভাইঃ তুই তো শুক (সুখ) জয় করেই ফেলেছিস। এবার একটা বড় পাহাড় এর মাথায় নিয়ে গিয়ে আমাকে জয় করতে পারবি না?
- গাইডঃ অবশ্যই পারবো। কিন্ত কীভাবে!
- বাবু ভাইঃ তুই আমাদেরকে গাইড করছিস নাকি আমরা তোকে গাইড করছি? বুঝতে পারছি না। যেহেতু বুঝতে পারছিই না সেহেতু পাহাড়ের মাথায় নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দে। পারবি না?
- গাইডঃ উফ্ (শুকজয় প্রতিবারই উফ্ বলার সময় চোখ বন্ধ করে)। অবশ্যই পারবো। কিন্ত তারপর আমাকে থানায় নিয়ে যাবে। আমার একটা ছেলে আছে, বউ আছে। তাদের কী হবে?
- বাবু ভাইঃ বাপ্রে, বাপ! তোর তো দেখি বিরাট চিন্তা! এত চিন্তা নিয়ে ধুকে ধুকে না মরে বরং চল দুই ভাই একসাথে লাফ দিয়ে মরে গিয়ে চিন্তামুক্ত হই।
- গাইডঃ আমার মরার কোন শখ আপাতত নাই। আপনি চাইলে গিয়ে একাই মরেন। তবে দেশী মুরগী পাওয়া যায়নি। খাবেন কী রাতে? আপনি তো ব্রয়লার খান না।
- বাবু ভাইঃ তোকে মুরগী কিনতে পাঠিয়েছি সেই সকালে আর রাত আটটায় ফিরে এসে তুই বলছিস, “দেশী মুরগী খুঁজে পাসনি”! তুই এখন যা তো ভাই, যা। আমরা না খেয়ে থাকব রাতে। আমাদের জন্য কিছুই তো করতে পারলি না। শান্তিতে ঘুমাতে দে অন্তত। তোর বাকী কথা সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনবো।
হতাশ হয়ে শুকজয় আবারো চোখ বন্ধ করে “উফ্” বলে চলে গেল। রাত বাড়তে শুরু করল। আড্ডা জমে উঠল। অনেকদিন এরকম আড্ডা জমে না। সবার ফোন বন্ধ__ চার্জ শেষ। বিদ্যুৎ নেই, নেটওয়ার্ক নেই, ব্যবসায়িক আলাপ নেই এমনকি শহুরে কোলাহল নেই। আড্ডার সাথে রাত গভীর হতে থাকল। এক এক করে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল।
এক কোটি বছর পর নওসাদ সকালে ঘুম থেকে উঠল। সূর্যের আলো তখনো পাহাড় স্পর্শ করেনি। রাতের ঘুম গাঢ় না হলেও ঘুম থেকে উঠার পর যথেষ্ট ফ্রেশ লাগছে। চা খেতে ইচ্ছে করছে। প্রান্ত, রশ্নি এবং বাবু ভাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নওসাদ গিয়ে বসল জলপ্রপাত এর একদম প্রান্তে। পাশেই ছোট্ট পাহাড়ি টং থেকে চা আসল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রশ্নি প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বলল__
- রশ্নিঃ যখন কোন মানুষকে তার আশেপাশের কিছু মানুষ পাগল বলতে শুরু করবে তখন সেই সুস্থ মানুষও কিন্ত একসময় নিজেই নিজেকে পাগল ভাবতে শুরু করবে।
- প্রান্তঃ কিন্ত কেউ যদি ছোটবেলা থেকেই ওইরকম পরিবেশে বড় হয়ে থাকে?
রশ্নি সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে টান দিয়ে বলল, “বড় তো হয়েই গেছে। এখন নিজের বিবেক-বুদ্ধি হয়েছে। নিজের ভাল-মন্দ বুঝতে শিখেছে। পাগলও কিন্ত নিজের ভাল বোঝে। একটা মানুষকে যদি সবসময় ডিরেকশন দেয়া হয় তাহলে একটা সময় পর ওই মানুষটা ডিপেন্ডেবল হয়ে পড়ে। তখন তাকে দেখে মানসিক রোগী মনে হয়। এইটা মনে হবার পর এই রোগ আরো বাড়তে থাকে এবং এর শেষ পরিনতি হচ্ছে আত্বহত্যা”।
প্রান্ত আর কথা বাড়াল না। তবে তার ভ্রু সামান্য কুঁচকে গেল। সবার চা শেষ হতেই দিপ্ত এবং পারিশাকে আসতে দেখা গেল। ওদেরকে নিয়ে সবাই রওনা দিল পাশেই একটি ঝিরির উৎসমুখে। দেখে মনে হচ্ছে এই রাস্তায় অনেকদিন কেউ পা বাড়ায়নি। তারপরও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ি ট্রেইল ধরে নিচে নামল সবাই। দুইপাশে অসংখ্য মাকড়সার জাল। বেশ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ঝিরির আরো ভেতরে প্রবেশ করল তারা।
ঝিরিটার ভেতরে অদ্ভুৎ সুন্দর! ঝড়নার পানি প্রবাহের শব্দ ব্যতীত আর কোন শব্দ নেই। নিরবতা ভেঙে দিয়ে রশ্নি পোর্টেবল স্পিকারে গান চালু করল__ “আমি বনফুল গো…”। এরকম অদ্ভুৎ সুন্দর যায়গা দিপ্ত এবং প্রান্ত ব্যতীত এই টীমের কেউই আগে কখনো দেখেনি। পাহাড়ি এলাচ হিমশীতল আবহাওয়াতেও শরীর যথেষ্ট গরম রাখছে। বনফুল গানের সাথে বাবু ভাই নাচছে। দিপ্ত, পারিশা এবং রশ্নি পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে। প্রান্ত পানিতে গলা অব্দি ডুবিয়ে জল-চিকিৎসা নিচ্ছে। সবাই একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল।
যখন ঘোর কাটল তখন দুপুর বারোটা। সবাই ঝিরি থেকে বাইরে বেড়িয়ে একটা টং এ চা খেতে খেতে অনেকটা সময় কাটাল। কটেজে ফিরে গিয়ে দুপুরের খাবার খেল। একসময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। তবে রোদের তাপ তখনো কমেনি। উত্তাপের মধ্যেই সবাই আবারো গিয়ে বসল জলপ্রপাত এর কিনারায়। প্রচন্ড গতিতে গ্যালন গ্যালন জল বিকট শব্দে নিচে পড়ছে। সূর্যের আলো এসে গলে গলে পড়ছে সেই জলরাশির ওপর। বিস্তৃত জলরাশি দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল এবং সন্ধ্যার পর কটেজে আবারো আড্ডা জমে উঠল__
- পারিশাঃ মানুষের জীবন এত অদ্ভুৎ কেন!
- বাবু ভাইঃ কী রকম অদ্ভুৎ! খুলে বলতো বুবু।
- পারিশাঃ ছোটবেলায় জীবন কত সুন্দর ছিল! আস্তে আস্তে বড় হচ্ছি। জীবন জটিল হয়ে যাচ্ছে।
- রশ্নিঃ কী রকম জটিল হয়ে যাচ্ছে?
- পারিশাঃ মানুষের জীবন সবথেকে সুন্দর হয় শৈশবে। জটিলতা শুরু হয় কৈশর থেকে। যৌবনে জটিলতা হয়ে যায় জটিলতর। মানুষ এই সময়ে এসে প্রেম, ভালবাসা এবং আবেগে জড়িয়ে যায়। আবেগের বশে একসময় বিয়েও করে ফেলে। আসল জটিলতা শুরু হয় বিয়ের পর।
- দিপ্তঃ পারিশা, এইটা তুমি কি বললে! কেমন জটিলতা শুরু হয় বিয়ের পর (দিপ্ত সাধারণত কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। আজ হঠাৎ পারিশাকে এই প্রশ্নটা করল)?
- পারিশাঃ বিয়ের পর মানুষের জীবন থেকে প্রেম হারিয়ে যায়। আবেগ শেষ হয়ে যায়। এই স্টেজে মানুষ মিথ্যা বলতে শুরু করে।
- দিপ্তঃ মিথ্যা বলতে শুরু করে মানে!
- পারিশাঃ ধর, অনেকদিন প্রেম করার পর দুইজন মানুষ বিয়ে করল। বিয়ের পর কিছুদিন খুব সুন্দর সময় কাটাল। তারপর হঠাৎ একদিন মানুষটাকে অচেনা মনে হতে শুরু হল। মানুষটার চাল-চলন, কথা-বার্তা, তাকানো, হাসি সবকিছুই অন্যরকম হয়ে গেল। মানুষটা ব্যবসায়িক কাজের অজুহাতে ট্যুরে গিয়ে মিথ্যা বলল অথবা সত্য গোপন করে গেল।
পারিশাকে থামিয়ে দিয়ে নওসাদ কাগজ-কলম রেখে পারিশার দিকে তাকাল, সিগারেট ধরাল এবং শান্তভাবে কথা বলতে শুরু করল__
- নওসাদঃ এইটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আরেকটা উদাহরণ দিয়ে তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। ধর, দুইজন মানুষ ব্যবসায়িক কাজে অন্য কোন শহরে গেল এবং কাজ শেষ করতে না পারায় রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। শহরে ভাল কোন থাকার ব্যবস্থা না থাকায় শহর থেকে অনেকটা দূরে নির্জন একটা রিসোর্টে রাতে ঘুমানোর বা রেষ্ট নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কাপল কটেজ হবার কারণে কাপল পরিচয়ে একটা রুম বুক করে সেখানে রাত্রিযাপন করতে বাধ্য হল।
কথার এই মূহুর্তে এসে পারিশা এলাচ এর বোতল হাতে নিয়ে নওসাদ এর দিকে তাকিয়ে বলল__
- পারিশাঃ ভাইয়া, একটা কথা বলব? অবশ্য, যদি কিছু মনে না করেন…
- নওসাদঃ আমি খুব সহজে কিছু মনে করিনা। একটা কেন, একশটা কথা বল।
- পারিশাঃ আপনি যে কথাগুলো বলছেন সেইগুলো কি সত্যি ঘটনা?
- নওসাদঃ শুরুতেই বলেছি, “ধর, দুইজন মানুষ কোন এক ব্যবসায়িক কাজে…”
- পারিশাঃ ও, আচ্ছা আচ্ছা। বলেন বলেন, তারপর…
- নওসাদঃ দুইজন মানুষ কোন এক ব্যবসায়িক কাজে আটকে গিয়ে বাধ্য হয়ে একসাথে রাত্রিযাপন করল এবং কেউ একজন বাসায় বলল, “জরুরী মিটিংয়ে সে ব্যস্ত”। এতে দোষের কি আছে?
আড্ডার এই মুহূর্তে রশ্নি কথা বলে উঠল, “দোষের হয়তো কিছুই নেই। তবে কেউ যদি আমাকে মিথ্যা বলে এবং আমি যদি তা ধরে ফেলি, তাহলে মিথ্যা শোনার পর মানুষটার সাথে আমি আর থাকব কি না সেটাও আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার”।
- নওসাদঃ সবারই কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার-স্যাপার থাকে, সেখানে হাত না দেয়াই ভাল।
- পারিশাঃ কেমন ব্যক্তিগত ব্যাপার!
- নওসাদঃ আঁকিবুকি, লেখালেখি, আড্ডা, গল্প, কবিতা, প্রেম এই সবই হচ্ছে ব্যক্তিগত অনিয়ন্ত্রিত ব্যাপার-স্যাপার। তুমি বা আমি চাইলেই এইগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। এইগুলো আসে মানুষের ভেতর থেকে। তাই কিছু ব্যাপার প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দেয়াই ভাল। আজ অব্দি প্রকৃতি কারোই খারাপ চায়নি এবং কাউকেই তার নিয়মের বাইরে যেতে দেয়নি।
- পারিশাঃ আর যদি কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার অন্য কারো জীবনে কাঁটার মত বিধে থাকে?
- নওসাদঃ ঠিক তখনই উপযুক্ত সময় নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার। এই স্টেজে মানুষ আঁকিবুকি, লেখালেখি, আড্ডা, গল্প, কবিতা, প্রেম এসবে জড়িয়ে যায়। কাঁটা বিধে থাকা জীবন কাঁটামুক্ত করে নিজের মত বাঁচতে শেখে। নিজের জন্য বাঁচে।
হঠাৎ বাবু ভাই প্রসঙ্গ বদলে বললেন__
- বাবু ভাইঃ শালা জীবনে একবার যদি আলাদিনের চেরাগ হাতে পেতাম! দৈত্যকে বলতাম বউদের চিন্তাভাবনা চেঞ্জ করতে। কোথাও গেলেই ভাবে আমি বোধহয় কারো সাথে ফস্টিনস্টি করে বেড়াচ্ছি। ট্যুরে এসে তোরা যা করছিস আমিও তাই তো করছি, নাকি!
- রশ্নিঃ প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই একেকটা চেরাগ বাবু ভাই। একজন মানুষ এই চেরাগ জীবনে একবারই পায়। কেউ ঘষা দিতে পারে আবার কেউ না পেরে নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে আশেপাশের মানুষের চিন্তায় ব্যস্ত থাকে।
রশ্নির কথা শুনে বাবু ভাই কপাল কুঁচকে শুয়ে পড়লেন এবং কম্বল গায়ে দিতে দিতে বললেন, “এই জন্যই তোদেরকে আমি এত পছন্দ করি। তোরা মানুষ ছোট হলেও তোদের চিন্তাভাবনার এরিয়া বিরাট। অনেক রাত হয়েছে, চল এবার ঘুমাই”। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল এবং সকালে উঠে রওনা দিল রেমাক্রীর উদ্দ্যেশ্যে।
এতক্ষণ গাইডেরর কোন খোঁজ ছিল না। রেমাক্রী জলপ্রপাত পৌঁছানোর ঠিক আগ মুহুর্তে গাইডকে দেখা গেল। গত কয়েকদিনে এই প্রথমবার গাইড নিজে একটা উদ্যোগ নিয়েছে। নিজ উদ্যোগে সবাইকে নিয়ে আসার জন্য সিন্দাবাদের জাহাজের মত তীব্র গতিতে নৌকা নিয়ে সবেমাত্র রেমাক্রী থেকে রওনা দিয়েছে ঠিক তখনই অন্য একটা নৌকায় সবাইকে আসতে দেখে গাইড তার নিজের নৌকা সোঁ-সোঁ করে ঘুরিয়ে রেমাক্রী ঘাটে ভেড়াল। গাইডের সাথে কেউই কোন কথা না বলে রেমাক্রী জলপ্রপাতে গোসল সেরে সোনাদিয়া দ্বীপের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল।
সোনাদিয়া দ্বীপ, কক্সবাজার। রাত একটা সাতাশ মিনিট। কিছুক্ষণ আগেও সবাই আড্ডা দিচ্ছিল। এখন নিজ নিজ তাবুতে ঢুকে পড়েছে। শুধু নওসাদ গিয়ে বসেছে দোলনায়। হাতে কাগজ-কলম আর জ্বলন্ত সিগারেট। সোনাদিয়া দ্বীপে ঝাউবনের পাশে সমুদ্র তীরে তাবু টাঙ্গানোর অভিজ্ঞতা সে তার ব্যক্তিগত ডাইরিতে লিখে রাখছে। অবশ্য এই মাঝরাতে দোলনায় একা বসে সামনের তাবুর মানুষগুলোর জীবনের গল্প লেখার জন্য ঠিক এইরকম একটা দোলনাই লাগে।
দোলনায় বসে জীবনের অতি বাস্তব গল্প লিখতে লিখতে নওসাদ দ্বিতীয় সিগারেট জ্বালিয়ে খেয়াল করল রশ্নির তাবুতে মোবাইলের আলো দেখা যাচ্ছে। বাবু ভাই, প্রান্ত, দীপ্ত এবং পারিশার তাবু অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্যেই পারিশা বাইরে বেড়িয়ে এল। গভীর রাতে সমুদ্র তীরে হাঁটতে ইচ্ছে করছে তার। পারিশা ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে সমুদ্রতীরের দিকে হাঁটতে শুরু করল…
বরেন্দ্র রিসোর্ট, রাজশাহী। তিন বছর পরের কথা। একদিন দুপুরে বাবু ভাই তার দলবল নিয়ে হাজির হলেন বরেন্দ্র রিসোর্টে। ছিপ ফেলে মাছ ধরা তার অন্যতম একটি শখ। গভীর রাতে মাছ ধরতে তার নাকি আরো ভালো লাগে। চতুর্থ মাছ ধরার পর অভ্র (টনি ভাইয়ের ছেলে। বয়স আনুমানিক দশ বছর) পুকুর ঘাটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল__
- অভ্রঃ মেয়েদের কি দাড়ি-গোফ হয় বাবু ভাই?
- বাবু ভাইঃ হ্যা, হ্যা। মেয়েদেরও দাড়ি হয়, মোছ হয়। সাপেরও মোছ হয়। তুমি কখনো মোছওয়ালা সাপ দেখেছ?
- অভ্রঃ নারে ভাই। কোন ক্লাসে পড় তুমি?
- বাবু ভাইঃ আমি পড়ি-টড়ি না। রাতে মাছ ধরি, দিনে ঘুমাই।
- অভ্রঃ তুমি কি বড় হয়ে ফাকিবাজ হয়েছ?
- বাবু ভাইঃ এক প্রকার ফাকিবাজই বলা যায়। অভ্র, তুমি বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও বাবা?
- অভ্রঃ আমাকে তাসমিম বল…
- বাবু ভাইঃ সরি বাবা, আমার ভূল হয়েছে। তাসমিম, বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?
- অভ্রঃ ডাইনোসর হতে চাই।
- বাবু ভাইঃ খবরদার! হাতি-ঘোড়া যাই হও না কেন ডায়নোসর হওয়া যাবেনা। ডায়নোসর কিন্ত নাক ডাকে।
- অভ্রঃ ইমোজি’র ফেস কেন স্মাইলি হয়?
- বাবু ভাইঃ এইটা তো আমি জানিনা। তুমি জানো কেন হয়?
- অভ্রঃ কারণ, ওরা জড়।
- বাবু ভাইঃ ও, আচ্ছা। চল এবার যাই।
- অভ্রঃ আমি এখন যাব নারে ভাই।
- বাবু ভাইঃ সন্ধ্যা হয়ে গেছে। যাবে না কেন!
- অভ্রঃ আমার ইচ্ছা।
- বাবু ভাইঃ ও, আচ্ছা।
সন্ধ্যায় পুকুর ঘাটে আড্ডা দেয়ার সময় ব্রুনোকে (জার্মান শেফার্ড) ছেড়ে দেয়া হল। রশ্নির কুকুর, মুরগী এবং ইঞ্জেকশন এই তিনটি বিষয় ভাল না লাগায় সে কুকুরটিকে বেধে রাখতে বলল। কুকুরটি সারাদিন বাধা অবস্থায় থাকার কারণে সন্ধ্যায় ছেড়ে না দিলে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে ভেবে সবাই কুকুরটিকে ছেড়েই রাখতে চাইল। তখন রশ্নি বলল, “তোমরা কিছুক্ষণের জন্য বেধে রাখো, আমি দোতলায় যাই তারপর আবার ছেড়ে দাও”। বাবু ভাই বিষয়টা নিয়ে মজা করতে শুরু করলেন। হঠাৎ রশ্নি পরিবেশ ভারি করে দিয়ে বাবু ভাইকে অনুরোধ করলেন তাকে বাসায় রেখে আসার জন্য। বাবু ভাই রশ্নিকে বাসায় রেখে শবনমের কাছে গেলেন এবং আড্ডায় আর ফিরে আসলেন না।
কিছুক্ষণ পর টনি ভাই, রিতু এবং সুমন ভাই আড্ডায় যোগ দিলেন। টনি ভাই বাবু ভাই এবং রশ্নি’র চলে যাবার কথা শুনে ওদেরকে ফোন করলেন। বাবু ভাইকে ফোনে না পেয়ে শুধু রশ্নিকে বাসা থেকে আবারো রিসোর্টে নিয়ে আসলেন। ততক্ষণে রাত বারোটা। বারোটা থেকে তিনটা অব্দি বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকার পুকুর ঘাটে অনেকদিন পর বাবু ভাইকে ছাড়াই আড্ডা জমে উঠল…
এই তিন বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে__ বাবু ভাই দেশের বাইরের বিলাসবহুল ট্যুর বাদ দিয়ে দেশের মধ্যেই ট্যুর দিয়ে বেশী আনন্দ পাচ্ছেন। কলেজ কাছে হওয়ায় এবং বাবু ভাইয়ের কর্মকান্ড ভাল না লাগায় শবনম ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়ীতেই বাস করছেন। দীপ্ত’র ব্যবসা এবং দ্বায়বদ্ধতা এতটাই প্রসার ঘটেছে যে ব্যবসা ব্যতীত তার হাতে এক ফোটা সময়ও নেই। প্রান্ত জল-চিকিৎসা নিতে নিতে খাওয়া-ঘুম সব জলের মধ্যেই শুরু করেছে।
রশ্নি এখন এই নগরীর একজন রোল মডেল__ তার চিন্তা, জীবন-দর্শন, মতবাদ এখন আর এই পৃথিবীর শুধুমাত্র একজন মানুষ বিশ্বাস করে না, অনেকেই তার জীবনধারা অনুকরণ করতে শুরু করেছে। এই তিন বছরে অনেকে অনেক কিছুই হয়েছে। শুধু নওসাদ কিছুই না হয়ে সারাদিন কাগজ-কলম নিয়ে পড়ে থাকে।
পারিশা বাড্ডায় একটি পুরোনো বাসায় একাই বাস করে। ছবি আঁকে। পাশাপাশি রাজশাহীতে একটি রিসোর্ট রিমোর্টলি পরিচালনা করে। মন খারাপের রাতগুলোতে রং-তুলি আর ক্যানভাস ছেড়ে লং ড্রাইভে বেড়িয়ে পড়ে, নিজেই ড্রাইভ করে; নিজের জন্য করে।