হিলটপ কটেজ

শান্তি বাড়ি। রাধানগর, শ্রীমঙ্গল। গভীর জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে একটি মেয়ে মরে পড়ে আছে। পাশেই হিলটপ কটেজ। কটেজে ছোট্ট দুইটি ঘর। ঘরের চাল ছনের হলেও ঘরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র লাগানো আছে। পাহাড় এর চূড়া থেকে সূর্যোদয় দেখার জন্য ঘরের পূর্ব পাশের দেয়ালটি কাঁচ এর করা হয়েছে।

তপ্ত দুপুর। এই ভর দুপুরে গহীন জঙ্গলে একটি মেয়ে মরে পড়ে আছে অথচ কেউ এখনো টের পায়নি। সূর্যোদয়ের ঠিক আগ মূহুর্ত থেকে এখানে এই পাইন গাছের সাথে ঝুলে আছে মেয়েটি। এখন দুপুর। কিছুক্ষন আগেই কয়েকজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ এসে উঠেছে কটেজে।

কাহিনীটা শুরু হয় ঠিক সন্ধ্যার আগে। গোধূলিবেলা। হঠাৎ কটেজ থেকে নওসাদ বের হয়ে পাহাড়ের চূড়ায় গহীন জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে শুরু করে। হাতে জলন্ত সিগারেট। চোখে ভয়ের ছাপ নেই, এমনকি প্রতিটি ধাপ ফেলার মধ্যে কোন দ্বিধা নেই। নওসাদকে দেখে মনে হচ্ছে এই জঙ্গল তার কতদিনের চেনা!

হাঁটতে হাঁটতে নওসাদ পাইন গাছ এর নীচে এসে দাঁড়াল। গাছের গোড়ায় হাত পা ছড়িয়ে বসল এবং মোবাইল ফোনে সন্ধ্যাকালীন রাগ মধুবন্তী চালু করল। গোধূলিবেলায় রাগ মধুবন্তী শুনতে মধুর হয়, কিন্ত এত যে মধুর হয় তা সে কখনোই জানতো না। রাগ মধুবন্তী গিয়ে মিশে যাচ্ছে গোধূলির হলুদ আভায়। মরে যাবার পরও ওপরে ঝুলে থাকা মেয়েটির প্রচন্ড বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে।

গহীন জঙ্গলে কিছুক্ষণ হাঁটার পর নওসাদ এর মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করতেই বাবু ভাই বলল –

  • বাবু ভাইঃ হ্যালো! কোথায় তুই?”
  • নওসাদঃ হাঁটতে হাঁটতে গহীন জঙ্গলে চলে এসেছি বাবু ভাই।
  • বাবু ভাইঃ আমিও জঙ্গলে ঢুকেছি। কিন্ত খুব বেশী ভেতরে না। হাতে একটা লাঠি থাকলে আরো ভেতরে যাওয়া যেত।
  • নওসাদঃ কতদূর এসেছেন?
  • বাবু ভাইঃ বিরাট পাইন গাছটা আছে না? ওই গাছের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি।
  • নওসাদঃ ওখানে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট জ্বালান। সিগারেট শেষ হতেই আমি চলে আসব।
  • বাবু ভাইঃ পাগল ছেলে! সিগারেট আমি জ্বালাবো ঠিকই। কিন্ত এই ভরা সন্ধ্যায় জঙ্গলের মধ্যে আমার খুব ভয় করছে। আমি কটেজে ফিরে যাচ্ছি। তুইও তাড়াতাড়ি চলে আয়।
  • নওসাদঃ ভয় নেই বাবু ভাই। আপনি চলে যান, আমি ঠিক চলে আসবো।

কটেজে কবির ভাই এবং রশ্নি মুখোমুখি বসে আছে। দুজনই কি এক বিষয়ে গভীর আলোচনায় মুগ্ধ। রশ্নি হাত নেড়ে কথা বলছে এবং কবীর ভাই মনোযোগ দিয়ে রশ্নির কথাগুলো শুনছে। হঠাৎ কবির ভাই বললেন, “আমার মেয়েকে তোমার মত করে গড়ে তুলতে চাই”।

  • রশ্নিঃ আমার মত করে গড়ে তুলতে চাইলে আপনার মেয়ে খারাপ হয়ে যাবে। আপনি শুধু আমার ভালো দিকগুলোই দেখছেন তাই আমাকে ভাল লাগছে। আমার অনেকগুলো খারাপ দিকও আছে। আর সবকিছু মিলিয়েই কিন্ত আমি।
  • কবির ভাইঃ তুমি কীর্তিমান মানুষ। একজন সফল উদ্যোক্তা। কেউ চাইলেই অবশ্য তোমার মত হতে পারবেনা। আমার মেয়ে যেটাই হোক আর যাই করুক, কোন অঘটন না ঘটালেই হয়।
  • রশ্নিঃ অঘটন না ঘটালে শিখবে কি করে যে কীভাবে অঘটন ঘটে! ওকে ওর মত থাকতে দিন। প্রকৃতি কাউকে তার নিয়মের বাইরে যেতে দেয়না। আর তাছাড়া সবারই কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকে, সেখানে হাত না দেয়াই ভাল।
  • কবির ভাইঃ কেমন ব্যক্তিগত ব্যাপার!
  • রশ্নিঃ যেমন ধরেন লেখালেখি আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখন কেউ এসে আপনাকে বলল, ” সারাদিন কাগজ-কলম নিয়ে কি-সব করেন… এইসব না করলে হয়না?” তখন কেমন লাগবে আপনার?
  • কবির ভাইঃ আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।
  • রশ্নিঃ আবার, কেউ যদি আপনাকে আমাদের সন্ধ্যার ব্যাচেলর আড্ডায় যেতে নিষেধ করে তখন কেমন লাগবে?
  • কবির ভাইঃ এইবার আমার আসলেই মন এবং মেজাজ দুইটাই খারাপ হবে।
  • রশ্নিঃ লেখালেখি, আড্ডা, গল্প, কবিতা, প্রেম এইসবই হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ব্যাপার-স্যাপার। আপনি বা আমি চাইলেই এইগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। এইগুলো আসে মানুষের ভেতর থেকে। তাই কিছু ব্যাপার প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দেয়াই ভাল। আজ অব্দি প্রকৃতি কারোই খারাপ চায়নি এবং কাউকে তার নিয়মের বাইরেও যেতে দেয়নি।
  • কবির ভাইঃ তুমি আমার চিন্তা কিছুটা কমালে। এই জন্যই তোমাকে আমি এত স্নেহ করি।

কবির ভাই এর কথা শেষ হতেই বাবু ভাই রুমে প্রবেশ করলেন। বাবু ভাই মেঝেতে বসে বাম হাতের কনুই রশ্নির পায়ের ওপর রেখে সিগারেট ধরালেন এবং চশমাটা খুলতে খুলতে বললেন, “বাপ্রে! বাইরে যা অন্ধকার!” সিগারেট এ দ্বিতীয় টান দিয়ে কিছুটা দুঃশ্চিন্তা নিয়ে বাবু ভাই আবারো বললেন, “এই ছেলেটা এতক্ষণ আসেনা কেন!”

রশ্নি কাঁচের দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকালো এবং তারপর বাবু ভাই এর দিকে তাকিয়ে বলল, “পায়ে লাগছে বাবু ভাই। একটু সরে বসেন”।

  • বাবু ভাইঃ এরকম করছিস কেন তুই! হাতের হাঁটুই তো রেখেছি তোর পায়ের ওপর, একটা পাহাড় তো আর রাখিনি। নওসাদ আসছে না তাই নিয়ে আমি চিন্তায় মরে যাচ্ছি!
  • রশ্নিঃ নওসাদ ঠিকই চলে আসবে। চিন্তার কিছু নেই। তার থেকে বরং চিন্তা করেন রাতে আমারা কি খাবো। খুব সম্ভবত কটেজ এর ক্যান্টিন এ গিয়ে খেয়ে আসতে হবে।
  • বাবু ভাইঃ তুই কি পাগল! আমি এত ওপর থেকে, এই পাহাড় এর চূড়া থেকে শুধুমাত্র খাবার এর জন্য নীচে যাব! তবে এই মূহুর্তে যদি এক কোটি ক্যাশ টাকা দিস তাহলে আমি নীচে নামবো কিন্ত তারপর আর ওপরে উঠে আসবো কিনা সেই গ্যারান্টি দিতে পারছিনা।
  • রশ্নিঃ থাক, আপনার নীচে যেতে হবেনা। আমি, কবির ভাই আর নওসাদ ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে আপনার জন্য খাবার পাঠিয়ে দিব।

কথা শেষ না হতেই নওসাদ ঘরে ঢুকল। এতক্ষণে কবির ভাই কথা বললেন, “নওসাদ, তুমি বাবু ভাই এর কয়টা হাঁটু দেখতে পাচ্ছ?”

  • নওসাদঃ দুইটা দেখতে পাচ্ছি। কেন ভাইয়া!
  • কবির ভাইঃ আমি তো চারটা দেখতে পাচ্ছি।

বাবু ভাই আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, “রশ্নির পায়ের ওপর আমার হাতের হাঁটু ঠেশ দিয়ে বসেছিলাম। সেই থেকে ওরা দুইজনই কেমন করছে আমার সাথে। তুই এর একটা বিহিত কর।”

  • নওসাদঃ না, সেটাই। পায়ের যদি হাঁটু থাকে তাহলে হাতের হাঁটু থাকবেনা কেন! আপনি ঠিকই বলেছেন বাবু ভাই।
  • বাবু ভাইঃ এই কথাটাই এখন বোঝা এই দুইজনকে। আর শোন, ক্যান্টিন থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি। আজ সারারাত গান হবে। আজ আমিও একটা গান শোনাবো।
  • নওসাদঃ আপনি গানও গাইতে পারেন! কি গান বাবু ভাই?
  • বাবু ভাইঃ ফিরে আয় তারপর শোনাচ্ছি। কি গান সেইটা এখন বললে তো আকর্ষণ থাকবে না…

কিছুক্ষণ আড্ডা শেষে বাবু ভাই ছাড়া বাকী সবাই নীচের ক্যান্টিনে গেল। খুব ঘরোয়াভাবে রাতের খাবার খেল। তারপর চা খেতে খেতে ওয়েটারকে অনুরোধ করলো যেন একজনের খাবার, পানি ইত্যাদি রুমে পৌঁছে দেয়া হয়। ওয়েটার খাবার এবং পানি হাতে কটেজে গিয়ে দেখলেন বাবু ভাই ঘুমাচ্ছেন। ওয়েটার খাবারগুলো রেখে পাহাড়ের চূড়ায় গেলেন পানির ট্যাংক পরীক্ষা করে দেখতে। কারণ গত কয়েক ঘন্টা যাবত “কাপল” কটেজগুলোতে পানি সরবরাহ হচ্ছেনা কেন।

পানির ট্যাংক পাইন গাছটার পাশেই। ট্যাংকের কাছে যেতেই ওয়েটার এর শরীর অবশ হয়ে গেল। দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ওয়েটার এক দৌড়ে ক্যান্টিনে বসা কটেজ এর মালিক তারা ভাইকে ডেকে নিয়ে তারা ভাই এর চেম্বারে গেলেন। তখন রাত প্রায় ১২ টা। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে ওয়েটার খুব জোরে জোরে স্বাস নিতে লাগলেন। সম্ভবত তিনি খুব ভয় পেয়েছেন? তারা ভাই খুব শান্তভাবে ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে ওয়াংচি?”

  • ওয়াংচিঃ হিল টপ কটেজে রাতের খাবার দিয়ে তরাপর গিয়েছিলাম পানির ট্যাংক পরীক্ষা করতে…
  • তারা ভাইঃ সব ঠিক আছে? কাপল কটেজগুলোতে পানি আসছে এখন? আর তুমি এরকম হাপাচ্ছ কেন! ভয় পেয়েছ?
  • ওয়াংচিঃ জ্বী ভাই। পানির ট্যাংক এর পাশেই যে বিরাট পাইন গাছটা আছে ওই গাছের সাথে একটা লাশ ঝুলে আছে।
  • তারা ভাইঃ কি বলছ এইসব! লাশটি ছেলের নাকি মেয়ের!
  • ওয়াংচিঃ পানির ট্যাংক এর কাছাকাছি গিয়ে টর্চটা ওপরে ফেলতেই আলো গিয়ে পড়ল মেয়েটির মুখে। অল্প বয়সী কিশোরী মেয়ে। পরনে হলুদ শাড়ি। দেখে প্রথমে চমকে উঠলেও এক ধরণের মায়া হল মেয়েটিকে দেখে। কি করবো বুঝতে না পেরে দৌড়ে চলে এলাম আপনার কাছে।
  • তারা ভাইঃ ভাল করেছ। হিলটপ কটেজে যে চারজন গেষ্ট উঠেছেন তারা এখন কোথায়?
  • ওয়াংচিঃ তিনজন ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছেন আর একজন কটেজে ঘুমাচ্ছেন।
  • তারা ভাইঃ এইখানে চুপ করে বসে থাক। এই কথা আর কাউকেই বলবে না। খুব শীঘ্রই আমি ফিরে আসবো।

বলেই তারা ভাই গেলেন সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখানে গিয়ে হিলটপ কটেজ এর ক্যামেরায় রেকর্ড হওয়া সিসিটিভি ফুটেজ ওপেন করলেন। গতকাল রাত দুইটার পর থেকে পরবর্তী সন্ধ্যা অব্দি কোন রেকর্ড খুঁজে পেলেন না। সন্ধ্যার দিকের একটি ফুটেজ পাওয়া গেল।

ফুটেজে আবছা আলোয় এক তরুনকে পাইন গাছের পাশ দিয়ে জঙ্গলের গভীরে হেঁটে যেতে দেখা গেল। তার কিছুক্ষণ পরই পাইন গাছের নীচে অন্য একজনকে দেখা গেল। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভয় পাচ্ছে। লোকটি কার সাথে যেন ফোনে কথা বলল। তারপর পকেট থেকে সিগারেট এর প্যাকেট বের করে হাতে নিল এবং কিছুক্ষণ পরই আবার প্যাকেটটি পকেটে রেখে দিল। আবারো প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরিয়ে কটেজের দিকে চলে গেল।

তারা ভাই এর বুঝতে বাকী রইলো না যে হিলটপ কটেজের গেষ্টগুলোর আচরণ অস্বাভাবিক। তিনি ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে সাহায্য চাইলেন। লোকাল পুলিশ ষ্টেশনে খবর পাঠানো হল। নয় সদস্যদের একটি টিম নিয়ে এসআই লিয়াকত আলী রওনা দিলেন।

এতক্ষণে কবির ভাই, রশ্নি এবং নওসাদ চা শেষ করে কটেজে ফিরে এসেছে। একসময় ব্ল্যাক লেবেল চতুর্থ পেগ শেষ হওয়া মাত্রই বাবু ভাই এর মুখ দিয়ে সেই বিক্ষ্যাত গান বের হয়ে গেল –

সেই বড়ই গাছতলায়…

ধুলা দিয়া ঘর বানাইতাম আমরা দুইজনায়।

আজও মনে পড়ে যায়…

ঝড়ের দিনে আম কুড়াইতাম আমরা দুইজনায়।

বকুল ফুলের মালা গাঁথতাম বসিয়া দুইজন,

কোথায় আমি পইড়া রইছি, কোথায় সমীরন।।

কবির ভাই গাঁজা খান না। তারপরও পরম যত্মে গাঁজা বানাচ্ছেন। নওসাদ মন্দিরা হাতে বসে আছে। রশ্নি মোবাইল ফোনে কি একটা গানের লিরিক্স খুঁজছে। তারা এই আড্ডার নাম দিয়েছে ব্যাচেলর আড্ডা। এই আড্ডায় যার যা মন চায় তাই তা করতে পারে তবে অন্যের অসুবিধা না করে। আড্ডার সাথে সাথে রাত বাড়তে থাকল।

লিয়াকত আলীর নয় সদস্যদের পুলিশ টীম এসে পৌছে গেছে তারা ভাই এর চেম্বারে। তারা ভাই হাতের ইশারায় লিয়াকত আলিকে কি একটা বুঝিয়ে দিয়েই সোজা হেঁটে গেলেন সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখানে গিয়ে খুব শান্তভাবে লিয়াকত আলীকে বললেন, “আমার এই কটেজে একটি লাশ পাওয়া গিয়েছে। একটি অল্প বয়সী তরুনী পাইন গাছে ফাঁস নিয়েছে”।

  • লিয়াকত আলীঃ ফাঁস নিয়েছে আপনি কি করে বুঝলেন? সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডও তো হতে পারে। আপনি লাশ দেখেছেন?
  • তারা ভাইঃ না, দেখিনি। তবে আমার এক ওয়েটার নিজের চোখে দেখেছে। আমি ভিতু মানুষ ভাই, দেখতে যাবার সাহস হয়নি। তবে আমি চাইনা আমার এই কটেজ এর কোন রকম বদনাম হোক। বুঝেনই তো এটা আমার ব্যবসা।
  • লিয়াকত আলীঃ সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছেন?
  • তারা ভাইঃ জ্বী, সিসিটিভি ফুটেজ এর কিছু অংশ আমি দেখেছি।
  • লিয়াকত আলীঃ আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?
  • তারা ভাইঃ হিলটপ কটেজে আসা চারজন গেষ্ট এর আচরণ অস্বাভাবিক। আমার ধারণা উনারা এই ঘটনার সাথে জড়িত। আসেন আপনিও ফুটেজটি দেখেন। তারা ভাই সিসিটিভি ফুটেজ চালু করলেন। লিয়াকত আলী সহ সবাই মনোযোগ দিয়ে হিলটপ কটেজ এর ফুটেজ দেখতে লাগলেন।

এতক্ষণে রাত তিনটা বেজে গেছে। ঘুম কিংবা তন্দ্রার মধ্যেই কবির ভাই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন কে যেন তাকে ডাকছে। ডাকটা কবির ভাই এর খুব মধুর লাগছে। বার বার শুনতে ইচ্ছে করছে। তার নিজের নামের সাথে এত মমতা মিশিয়ে এর আগে কেউই ডাকেনি তাকে।

কবির ভাই চোখ খুলতে চেষ্টা করছেন কিন্ত পারছেন না। চোখ খুলতে না পারলেও তিনি বুঝতে পারছেন তার নাম ধরে যিনি ডাকছেন তিনি একটি অল্পবয়সী তরুনী। মেয়েটির কন্ঠ খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া কৈশরের কথা মনে পড়ছে। কবির ভাই উঠে দাঁড়ালেন এবং দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

মেয়েটির ডাক অনুসরণ করে তিনি কটেজ থেকে নীচে নেমে এলেন। মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরই মেয়েটির সাথে দেখা হবে অথচ তিনি হাঁটতে হাঁটতে পদ্ম পুকুর এর দোলনা অব্দি চলে এসেছেন। পদ্ম পুকুর সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিন কক্ষের পাশেই হবার কারণে লিয়াকত আলীর চোখ সিসিটিভির ফুটেজ থেকে জানালা দিয়ে গিয়ে পড়ল কবির ভাই এর দিকে।

লিয়াকত আলী দেখলেন একজন মানুষ দোলনায় বসে হাত নেড়ে নেড়ে একাই কথা বলছে। তারা ভাই আবছা আলোয় মানুষটিকে চিনতে পারলেন। হিলটপ কটেজে যারা উঠেছেন তার মধ্যে উনি একজন। এই তথ্য জানার পর লিয়াকত আলীর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দোলনায় বসা মানুষটির দিকে।

কবির ভাই ইচ্ছে করে এই কাজটি করেননি। তিনি বিশ্বাস করেন তাকে নিশি ডাকে। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ঘুমের ঘোরে নিশিডাক শুনতে পান এবং এর আগেও বেশ কয়েকবার তার সাথে একই ঘটনা ঘটেছে। প্রায়ই ঘুমের ঘোরে তিনি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর যখন ঘোর কেটে যায় তখন নিজেকে আবিষ্কার করেন অন্য কোন জায়গায়।

লিয়াকত আলী তারা ভাইকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ঠিক এমন সময় এক তরুণী প্রায় দৌড়ে এসে লিয়াকত আলীর সামনে দাঁড়িয়ে সাবলীলভাবে কথা বলতে শুরু করল, “আমি আনিকা। আপনাদেরকে এই রিসোর্টে আসতে দেখে ভরসা পেলাম। আমি কিছু কথা বলতে চাই”।

  • লিয়াকত আলীঃ বসুন। বসে আরাম করে কথা বলুন।
  • আনিকাঃ আমি একটি লেডিস হোষ্টেল এর ম্যানেজিং পার্টনার। কিছুদিন আগেই অরন্য এবং সাবিহা নামে দুই মেয়ে হোষ্টেলে উঠে। দুইজনই এডমিশন ক্যান্ডিডেট।
  • লিয়াকত আলীঃ আচ্ছা… তারপর?
  • আনিকাঃ গত পরশু আমার বিজনেস পার্টনার দুরুল হুদা এসে জানালেন, “হোষ্টেল থেকে ট্যুর এর আয়োজন করা হয়েছে। অন্যদের আগ্রহ না থাকায় শুধু আমি, অরন্য এবং সাবিহা দুরুল এর সাথে ট্যুরে রওনা দিই।
  • লিয়াকত আলীঃ বলুন, শুনছি আমি…
  • আনিকাঃ এই রিসোর্টে আসার পর দুরুল এর আসল চেহারা ফুটে উঠে। অতিরিক্ত মদ্যপান করায় স্বাভাবিক চেতনা হারিয়ে দুরুল উল্টা-পাল্টা আচরণ শুরু করে। বার বার অরন্যের হাত ধরছিল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম অরন্য অস্বস্তি অনুভব করলেও কিছু বলতে পারছিল না।
  • লিয়াকত আলীঃ তারপর…
  • আনিকাঃ গতকাল বিকেলে আমি পদ্ম পুকুর এর দোলনার পাশে চাটাই এ শুয়ে ছিলাম। অরন্য এবং সাবিহা পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে ছিল। এমন সময় দুরুল ফোনে অরন্যকে কি একটা বলল। কথা শেষ হতেই অরন্য আমাদেরকে কিছু না বলেই কটেজের দিকে চলে যায়। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পুকুরে বসে থাকার পর আমি এবং সাবিহা কটেজে ফিরে যাই। তারপর থেকেই অরন্য এবং দুরুল এর ফোন বন্ধ। অরন্য কনজাররভেটিভ ফ্যামালির বাচ্চা একটা মেয়ে। বাবা-মা দুইজনই ব্যস্ত থাকায় শৈশব এবং কৈশর কেটেছে চার দেয়ালের মধ্যে। বাইরের জগৎ সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই। এখন তো আমার দুঃচিন্তা হচ্ছে! মেয়েটি কোন বিপদে পড়ল কিনা কে জানে!

কথাগুলো বলেই আনিকা সিগারেট ধরাল। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। কুহক এর ডাক শোনা যাচ্ছে। লিয়াকত আলী তার নয় সদস্যের টীমসহ রওনা দিলেন তারা ভাই এবং আনিকাকে নিয়ে পাইন গাছের দিকে। হিলটপ কটেজের গেষ্টগুলো সারারাত আড্ডা শেষে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। লিয়াকত আলী তাদের সেই ঘুম ভাঙ্গালেন না। নিঃশব্দে পাইন গাছে ঝুলে থাকা লাশ নামিয়ে রওনা দিলেন থানার উদ্যেশ্যে।

এক এক করে সবাই ফিরে গেল নিজ নিজ গন্তব্যে। শুধু আনিকা বসে রইল হিলটপ কটেজের বারান্দায় একটি বাঁশের চেয়ারে পাথরের মূর্তির মত। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জবা গাছটির দিকে। জবা গাছটিতে অসংখ্য সবুজ পাতার মধ্যে একটি হলুদ পাতা। কটেজের একটি ঘর থেকে ভেসে আসছে রাগ ভৈরব। গম্ভীর প্রকৃতির এই রাগ করুণা ও নৈরাশ্যের প্রতীক। মূহুর্তেই আনিকার চোখ জলে ভরে উঠল। এরকম বিষাদময় সকাল সে তার এক জীবনে দেখেনি!

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon