নক্ষত্রের উদ্যান: এক মহাজাগতিক উপাখ্যান

মহাবিশ্বের এক নিভৃত কোণে, নীলাভ আভায় মোড়া এক গ্রহ, যেখানে বিস্তৃত এক রহস্যময় উদ্যান; নক্ষত্রের উদ্যান। এই উদ্যানের গাছপালাগুলো যেন মহাজাগতিক শক্তির প্রতিফলন। পাতাগুলো জ্বলজ্বল করে, ফুলগুলো নিজস্ব আলো ছড়ায়, আর বাতাসে অনবরত মৃদু সঙ্গীত ভেসে বেড়ায়। তবে এই সৌন্দর্য প্রকৃতির কীর্তি নয়; এটি এক উন্নত সভ্যতার পরীক্ষাগার।

এখানেই শৈশব কাটায় দুই মানব সন্তান, কিয়ান ও রাইনা। অজানা এক রহস্যের অধীনে পৃথিবী থেকে তাদেরকে এখানে আনা হয়েছিল। তাদের মনে নেই কোনো অতীত কিংবা কোনো পরিচিত মুখ। চারপাশে শুধু বিস্ময়কর উদ্যান, স্বচ্ছ হ্রদ, আকাশে বিশাল তিনটি চাঁদ, আর অদৃশ্য রক্ষকদের অস্তিত্ব।

প্রথমদিকে, কিয়ান ও রাইনা আতঙ্কিত ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা এই উদ্যানকে আপন করে নেয়। ফলমূল ছিল তাদের খাদ্য, ঝর্ণার জল ছিল তাদের একমাত্র পানীয়। আশ্চর্যের বিষয়, তারা কখনো অসুস্থ হতো না, কখনো বার্ধক্যের ছাপ পড়ত না। তারা শুধু বড় হচ্ছিল, শিখছিল, অনুভব করছিল।

তবে তারা একা ছিল না। কোথাও থেকে এক অদৃশ্য শক্তি তাদের পর্যবেক্ষণ করছিল। মাঝে মাঝে রাতে তারা অনুভব করত কোনো এক ছায়াময় উপস্থিতি। কখনো উদ্যানের গাছেরা কানের কাছে ফিসফিস করত, কখনো আকাশে এক মুহূর্তের জন্য ঝলসে উঠত এক অদ্ভুত আলোর রেখা। তারা বুঝতে পারত, এটি কোনো সাধারণ স্থান নয়।

সময়ের পরিক্রমায় কিয়ান ও রাইনার মধ্যে নতুন অনুভূতির জন্ম হয়। তারা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে, অনুভব করে হৃদয়ের স্পন্দন। একসঙ্গে সময় কাটানো, হাত ধরে রাখা, একে অপরকে নতুন চোখে দেখা; সবকিছুই এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। কিন্তু এই আকর্ষণের অর্থ কী, তা তারা জানত না। তাদের শেখানোর কেউ ছিল না।

তবে তাদের এই পরিবর্তন নজর এড়ায়নি অদৃশ্য পর্যবেক্ষকদের। তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে এই আবেগের বিকাশ বিশ্লেষণ করছিল।

একদিন উদ্যানের কেন্দ্রে তারা এক আশ্চর্য বৃক্ষ আবিষ্কার করে। যার শাখাগুলো ছিল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, আর তাতে ঝুলছিল উজ্জ্বল নীল রঙের ফল। সেই ফল থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল এটি তাদের কিছু জানাতে চাইছে। অজানা এক আকর্ষণে তারা এগিয়ে গেল এবং সেই ফল ভক্ষন করল।

তারপরই ঘটল বিস্ময়কর কিছু! তাদের মনে এক বিস্ফোরণ ঘটল এবং তারা অনুভব করল তাদের অস্তিত্বের সত্যতা। তারা জানল, তারা কেবলই একটি পরীক্ষার অংশ আর এই উদ্যান কোনো রুপকথার স্বর্গপুরী নয়, বরং এক গবেষণাগার। অদৃশ্য পর্যবেক্ষকেরা ছিল উন্নত ভিনগ্রহী, যারা মানবজাতির মানসিক ও শারীরিক বিবর্তন পর্যালোচনা করছিল।

হঠাৎ আকাশ থেকে বজ্রপাত নেমে এলো, বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আর চারপাশে প্রতিধ্বনিত হলো এক গম্ভীর কণ্ঠ,

“তোমরা নিয়ম ভেঙেছ। তোমাদের এই উদ্যান ছেড়ে চলে যেতে হবে।”

পরবর্তী মুহূর্তেই এক প্রবল শক্তির ঝড়ে তারা উদ্যান থেকে উৎখাত হল। চোখের পলকে এক শুষ্ক ও নিষ্প্রাণ ভূমিতে গিয়ে পড়ল। সেখানে ছিল না কোনো সঙ্গীত, আলো বিচ্ছুরিত করা ফুল কিংবা পাতা। তারা শুধু নিজেদের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

কিন্তু তারা দুইজনই বুঝতে পারল যে প্রকৃত স্বাধীনতা কেবল সংগ্রামের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। তাই একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াল তারা।

নতুন ভূমিতে প্রথম কয়েকটি দিন ছিল দুঃসহ। খাদ্যের অভাব, পানির সংকট, আর ক্রমাগত পরিবেশের চাপে তারা যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কিয়ান এবং রাইনা সহজে হার মানাতে রাজি ছিল না। তারা প্রকৃতির সংকেত পড়তে শিখল, নতুন ধরনের ফলমূল আবিষ্কার করল এবং শিকার শিখল।

কিন্তু রাতের বেলায় তারা অনুভব করত কেউ তাদের অনুসরণ করছে। দূরে কোনো এক জ্বলজ্বলে চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি কোনো অজানা মহাশক্তি, নাকি সেই ভিনগ্রহী পর্যবেক্ষকদের নতুন এক পরীক্ষা?

বছর গড়িয়ে গেল। ততদিনে কিয়ান এবং রাইনা শুধু নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখেনি, বরং তারা একটি ছোট আশ্রয়ও গড়ে তুলেছে। তাদের মধ্যে ভালবাসা আরও গভীর হয়েছে, আর সেই ভালবাসার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে নতুন এক প্রাণের আবির্ভাবে। রাইনা জন্ম দিল তাদের প্রথম সন্তান, “নোভা”।

এই শিশুটি ছিল এক নতুন প্রজন্মের সূচনা। কিয়ান এবং  রাইনা বুঝতে পারল, তারা এক নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করতে চলেছে। কিন্তু তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ নজর রাখছে কেউ একজন বা কোন এক অজানা মহাশক্তি। তারা কি সত্যিই স্বাধীন, নাকি পর্দার আড়ালে আরও বড় কিছু ঘটতে চলেছে?

একদিন দূর আকাশে ঝলসে উঠল এক অদ্ভুত আলো। আকাশের বুক চিরে নামল এক বিশাল মহাকাশযান। কিয়ান আর রাইনা প্রথমে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেও তারা জানত এই দিন একদিন আসবেই।

মহাকাশযানের দরজা খুলে গেল এবং ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একদল উন্নত সভ্যতার প্রাণী। তাদের নেতার চোখ ছিল জ্ঞান ও রহস্যে পূর্ণ! তারা সামনে এসে বলল, “তোমরা পরীক্ষার শেষ স্তরে পৌঁছেছ। এখন সিদ্ধান্ত তোমাদের হাতে; তোমরা কি ফিরে যেতে চাও, নাকি এই গ্রহে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়বে?”

কিয়ান ও রাইনা একে অপরের দিকে এক পলক তাকাল। তারা জানত, তারা আর আগের মতো অসহায় নয়। এমনকি তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ এখানেই, এই নতুন গ্রহে। তাই তারা আর পিছিয়ে না গিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

তারা দুইজনই একসাথে উত্তর দিল, “আমরা এখানে থেকে যেতে চাই।”

ভিনগ্রহীরা একবার একে অপরের দিকে তাকাল, তারপর তারা মাথা নাড়ল। “তবে এটিই তোমাদের নতুন পৃথিবী,” বলেই তারা মহাকাশযানে উঠে গেল এবং মুহূর্তের মধ্যেই মিলিয়ে গেল অসীম নক্ষত্রের মাঝে।

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon