দূঃস্বপ্ন

বদ্ধ ঘর। ঘরের তিন কোণে আড়ং থেকে সদ্য কেনা তিনটি মোমবাতি জ্বলছে। একটা কোনে আমি বিছানায় বসে আছি। পরিবেশটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে আছে। বৃষ্টি পড়ছে, ঝুম বৃষ্টি। শহরের ভেজা নিয়ন বাতিগুলো জলে উঠেছে অনেক আগেই। জগত সংসারের সকল কর্মকান্ড যথানিয়মেই চলছে। সূর্য তার নিজ কক্ষপথে ঘুরছে। গ্রহ নক্ষত্রগুলোও দৈনন্দিন রীতি অনুযায়ী আবর্তিত হচ্ছে। নদীতে স্রোত বইছে। তাঁতীরা তাঁত বুনছে। কেউ আবার সেগুলো কিনছে। অফিস শেষে ক্লান্ত দেহে অনেকেই বাসায় ফিরেছে অনেক আগেই। দূর পাল্লার ব্যক্তিগত গাড়ীগুলো ছুটে চলেছে অবিরাম। কবির ভাই কিংবা জোশী হয়ত বসে পড়েছেন ছন্দ খুজতে। প্রত্যাহিক নিয়মে ক্লান্ত লোকগুলো যেমন টনি ভাই ঘুমিয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সবকিছুই তাদের নিজ নিজ নিয়মে হচ্ছে। সময় ও তারিখ নিশ্চয় সেই নিয়মের ব্যাতিক্রম নয়। কিন্তু আজকের দিনটা আমার জন্য বিশেষ একটা দিন।

বিশেষ কোন দিনের শুরুতে গোসল করতে হয়। আমিও করলাম। রাত প্রায় তিনটা। মুশলধারে বৃষ্টি পড়ছে। এতটাই বৃষ্টি পড়ছে যে বৃষ্টির পানি ছাদের ফাটল চুইয়ে আমার বিছানায় পড়ছে। বিছানা ভিজে যাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার! রুমের মধ্যে ক্যাম্প করার মত অবস্থা। আমি গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করছি, আজ হঠাৎ এত বৃষ্টি হবার পেছনে কারণ কি? গত বছরও কি এই দিনে কি বৃষ্টি হয়েছিল? তার আগের বছর? মনে পড়ছে না। গত দুইদিন যাবৎ কিছুই মনে থাকছে না। মস্তিষ্ক অত্যন্ত উত্তপ্ত অবস্থায় আছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে অনেককিছুই। বৃষ্টি হবার পেছনের কারণ খোঁজার চেষ্টা বাদ দিয়ে খাট সামান্য সরিয়ে শুয়ে পড়লাম। গল্পের বই পড়া যায়। বৃষ্টির বেগ অধিক থেকে অধিকতর হতে শুরু করেছে। ছাদ চুইয়ে বিছানায় পানি পড়ছে। বিছানা ভিজে যাচ্ছে। ভিজে ভিজে সিডনি শেলডন এর আত্মজীবনী পড়তে চমৎকার লাগছে_ দ্যা আদার সাইড অফ মি। বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাওয়া আমার পুরনো অভ্যাস। ঘুমিয়ে পড়েছি অনেক আগেই। ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারছি ঘুমিয়ে আছি এবং স্বপ্ন দেখছি।

স্বপ্নে দেখছি আমি হাসপাতালে। ভূতুরে হাসপাতাল। ভয়ঙ্কর পরিবেশ। সময় জানতে পারলে ভাল হত। হাতে ঘড়ি নেই। সূর্যের আলো নেই, রাতের অন্ধকারও নেই। রাত আর দিনের মাঝামাঝি একটা সময় হবে হয়ত। সবাই খুব অসুস্থ, মারা যাচ্ছে। আমি একদম সুস্থ, তারপরও আমাকে হাসপাতালে আটকে রাখা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে বের হবার খুব চেষ্টা করছি, পারছি না। যেদিকেই যাচ্ছি, যেভাবেই যাচ্ছি; ঘুরে আবার হাসপাতালেই ফিরে আসছি। স্বভাবতই স্বপ্নের নানা পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাপার আর রকম-সকম থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্বপ্নে চারুকলায় বসে গান করছি; কিন্তু বাস্তবে বসে আছি টিএসসিতে। স্বপ্নে গহীন জঙ্গলে সবুজ প্রজাপতি উড়ছে আর বাস্তবে মেঝের ওপর বসে আছে একটা বিড়ালছানা, তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

স্বপ্নে দেখছি আমি হাসপাতালে। কেউ একজন ভাত খাইয়ে দিচ্ছে, ঠিক যেমন মা খাইয়ে দিত ছোটবেলায়। এখন যিনি খাইয়ে দিচ্ছেন, তাকে দেখতে পাচ্ছি না; কিন্তু আমি নিশ্চিত ওটা মা ছাড়া আর কেউ নয়। স্বপ্নের মধ্যেই খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। পানি খাচ্ছি, সেই পানি আবার অশ্রুজলে পরিণত হয়ে টপটপ করে চোখ থেকে ঝরে পড়ছে। আমি জানি, কেন আমি কাঁদছি; কিন্তু নিজের কাছে স্বীকার করতে পারছি না। নিজের অলস হাত দুটোর দিকে তাকালাম। ওগুলো কল্পনায় এনে দিয়েছিল হাত-পা আর মাথামুণ্ডহীন মূর্তি, মর্মর পাথরের শরীর। যখন জেগে উঠলাম, চোখে কোনো পানি ছিল না; হাত দুটো নোংরা, দরজার কব্জাগুলো জংধরা, হূদয়ের কম্পন ছুটে বেড়াচ্ছে, ফুসফুস বাতাসশূন্য।

ঠিক সেই সময় ভাবছি, হাসপাতালে আছি—এই স্বপ্ন দেখাই বরং ভালো। চোখ বন্ধ করে ফেললাম, এবার দেখছি শহরের ইট-পাথর আর কোলাহল ছেড়ে কোন এক নির্জন রিসোর্টের সুইমিংপুলের কাঁচের মত স্বচ্ছ পানিতে লাশের মত ভেসে আছি। জেগে ওঠার কোনো ইচ্ছাই ছিল না, তারপরও জেগে উঠলাম, আক্যুরিয়াম ভেঙ্গে যাওয়ার শব্দে। তখন সেখানে কেউ ছিল না; ছিল না কোনো রিসোর্ট কিংবা সুইমিংপুল। ছিল শুধু ভাঙ্গা আক্যুরিয়ামের বিখন্ডিত টুকরোগুলো আর একটা ফাইটার ফিস।

স্বপ্নে দেখছি আমি হাসপাতালে। মা আর ভাত খাইয়ে দেয় না আমাকে, বিগত কয়েক বছর থেকে খুব বেশী যোগাযোগ হয় না মায়ের সাথে। মায়ের জন্য মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। তার চাহনি, তার গুনগুন, তার কোল, তার স্নেহাদর, তার তিরস্কার, তার ক্ষমা মনে পড়ছে। নিজেকে নিজেই আলিঙ্গন করছি। খুব সম্ভবত আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি অথবা গিয়েছি। জিমি অনেক দূর থেকে হাত তুলে বিদায় জানাচ্ছে, মনে হচ্ছে কোনো গোরস্থান থেকে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব! কোনো পার্ক হয়ত হবে ওটা, গোরস্থান নয়। অবশ্য হাসপাতালে কোনো পার্ক ছিল না, কেননা আমি তখন স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম; ওটা কী ছিল, সে ব্যাপারে সচেতন ছিলাম আমি—একটা স্বপ্ন। বিদায় জানানোর জন্য আমিও হাত উঠালাম। কিন্তু আমার হাত তখন মুষ্টিবদ্ধ ছিল, আর এটা তো সবাই জানে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে কাউকে বিদায় জানানো যায় না।

চোখ মেলতেই অতি পরিচিত খাটের ভেতর থেকে প্রচণ্ড ঠান্ডা ঠিকরে বেরিয়ে এল। শীতে কাঁপতে কাঁপতে নিঃশ্বাস বের করে হাত দুটো গরম করতে চেষ্টা করছি, নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। ঘরের কোনায় বসে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে বিড়ালছানাটি আমার মতো সেও শীতে কাঁপছে। আমি একটা হাত নাড়ালাম আর বিড়াল ছানাটি এক পা এগিয়ে আবার বসে পড়ল। একে অপরকে অনেক দিন ধরে চিনি আমরা।

এত কিছুর পরও স্বপ্নে অতি ক্ষিপ্র আর সবুজ প্রজাপতিটাকে মিস করছি, তাকে আবার দেখার আশায় ঘুমিয়ে পড়লাম। এবার আবিষ্কার করলাম, প্রজাপতিটা তার একটা পাখা হারিয়ে ফেলেছে। ওই রকম একটা স্বপ্নকে আর ভালো স্বপ্ন বলে বিবেচনা করা যায় না। সে যা-ই হোক, অতঃপর গুনতে শুরু করলাম আর কত বছর আমাকে হাসপাতালে থাকতে হবে: এক, দুই, তিন, হঠাৎ জেগে উঠলাম। তিন বছর ধরে চিকিৎসা চলার কথা, তিন বছর তো হয়ে গেল। আবার গুনছি, এখনও আঙুলগুলো জেগে আছে। মন্দিরা, বাঁশি, ঘোঙ্গর, বায়া, কাহন কিংবা ইউকেলেলে নেই। নিঃসঙ্গতা আর শূন্যতা পূরণের আশায় মাঝেমধ্যে ধীরে ধীরে গান গাইছি। খুব কম গানই মনে করতে পারছি।

ছোটবেলায় দাদির কাছ থেকে অনেকগুলো প্রার্থনা শিখেছিলাম; কিন্তু কার কাছে প্রার্থনা করব এখন? আমার মনে হয়, ঈশ্বরের দ্বারা প্রতারিত হয়েছি আমি, তবে ঈশ্বরকে ঠকাতে চাই না। স্বপ্নে দেখছি হাসপাতালে বসে বসে ভাবছি কোন একদিন ঈশ্বর আমার কাছে এসে হাজির হবেন আর স্বীকার করবেন যে তিনি প্রচণ্ড অনিদ্রায় ভুগছেন, যা তাকে ভীষণ ক্লান্ত করে তুলেছে। আর যখন আমি শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত নিদ্রার কোলে ঢলে পড়তে সক্ষম হলাম, দুঃস্বপ্ন দেখছি; যেখানে যিশু ক্রুশ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ঈশ্বরের সাহায্য প্রার্থনা করছে; কিন্তু ঈশ্বর খুব ব্যস্ত আছেন বলে তাকে কোনো সাহায্যই করতে পারছেন না।

ওই নিঃসঙ্গ ও পরিত্যক্ত ঈশ্বরের জন্য আমার আফসোস হচ্ছে। যেভাবেই হোক বুঝতে পারছি ঈশ্বরের অসুস্থতা হচ্ছে নিঃসঙ্গতা, কারণ চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে তার চিরস্থায়ী খ্যাতি সন্ত-সাধুদের ভীত করে তোলে। যখন জেগে উঠলাম, মনে করতে পারছি আমি একজন নাস্তিক, প্রায় সাথে সাথেই ঈশ্বরের প্রতি করুণা করা বন্ধ হয়ে গেল আর নিজের প্রতি করুণা অনুভবের বদলে দেখি আমি বন্দী, একাকী ডুবে আছি নোংরা আর অশেষ ক্লান্তির মধ্যে।

ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি অনেক আগেই। দীর্ঘ এই বিশ্রামের সময় আবারও স্বপ্ন দেখছি__আমি সেই হাসপাতালেই আছি, যেখানে বিড়ালছানা, খরগোশ ইত্যাদিসহ সবকিছু ঠিক আগের মতোই বিরাজমান।

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon