মানবীয় নফসের বৈষয়িক চিন্তাভাবনা, গতি প্রবাহ ও আমিত্ববোধকে বলা হয় দুনিয়া। মানুষ পৃথিবীতে বাস করে এবং দুনিয়া মানুষের নফসে অবস্থান করে। এককথায় মানুষ পৃথিবীতে বাস করে, আর দুনিয়া মানুষের ভিতরে অবস্থান করে। দুনিয়া হলো এক প্রতিফলনের ক্ষেত্র, যেখানে মানবীয় প্রবৃত্তি, আকাঙ্ক্ষা, লোভ, মোহ ও ক্ষমতার লালসা প্রবাহিত হয়। এটি এমন এক অবস্থা, যেখানে মানুষ পার্থিব স্বার্থের জন্য জীবন যাপন করে এবং আত্মার প্রকৃত মুক্তি থেকে দূরে থাকে।
অপরদিকে, হাশর হল সমাবেশ। এটি সেই পর্ব, যেখানে নফস মুক্তির আগ পর্যন্ত তকদীর তথা কর্মফল নিয়ে হাশরে দাঁড়িয়ে কর্মফল ভোগ করার জন্য। মানুষের জীবনের প্রতিটি কর্মের ফলস্বরূপ তাকে হাশরের মাঠে দাঁড়াতে হবে। কর্মের মাত্রানুসারে নফস দেহধারণ করে পৃথিবীতে বিচরণ করে এবং কর্মফল ভোগ করে। হাশর মূলত একটি চূড়ান্ত বিচার প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ তার জীবনের প্রতিটি কাজের হিসাব দিবে এবং সে অনুযায়ী তার পরবর্তী অবস্থান নির্ধারিত হবে।
দুনিয়া ও হাশরের মৌলিক পার্থক্য
১. দুনিয়া – পরীক্ষা ও মোহের স্থান
দুনিয়া মানব জীবনের একটি পরীক্ষাকেন্দ্র, যেখানে মানুষকে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। এখানে লোভ, হিংসা, দ্বন্দ্ব, সম্পদের প্রতিযোগিতা মানুষকে আসল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে। ফলে মানুষ সত্যিকারের আত্মজ্ঞান লাভ করতে ব্যর্থ হয়। এই পৃথিবীতে মানুষ নিজস্ব ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করে, কিন্তু সে জানে না তার প্রতিটি কাজের জন্য তাকে একদিন জবাবদিহি করতে হবে।
দুনিয়া এমন এক স্থান, যেখানে মানুষ তার ইচ্ছামতো জীবনযাপন করতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হয়। এখানে সম্পদ ও ক্ষমতার মোহ মানুষকে ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বুঝতে বাঁধা সৃষ্টি করে। তাই দুনিয়ার আসল উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন তার সত্যিকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে চলা।
২. হাশর – চূড়ান্ত বিচারের স্থান
হাশর হলো এমন এক স্থান, যেখানে দুনিয়াতে করা প্রতিটি কাজের ফলাফল প্রকাশিত হবে এবং ন্যায়বিচার সম্পন্ন হবে। হাশরের দিন মানুষ তার প্রতিটি কর্মের জন্য জবাবদিহি করবে এবং সেদিন কারো প্রতি অন্যায় করা হবে না।
হাশর সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “সেই দিন মানুষ তার সমস্ত কর্মসমূহ দেখতে পাবে, ভালো হোক কিংবা মন্দ।” (সূরা যিলযাল, আয়াত ৭-৮)
এটি এমন একটি জায়গা যেখানে কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারবে না, কোনো সুপারিশও কাজে আসবে না, যদি আল্লাহ তা না চান। সেদিন সবাই তার নিজ নিজ আমলের ফলাফল ভোগ করবে এবং ন্যায্য বিচার সম্পন্ন হবে।
দুনিয়া ও হাশরের সম্পর্ক
দুনিয়া হলো কর্মক্ষেত্র এবং হাশর হলো বিচারক্ষেত্র। যারা দুনিয়াতে ভালো কাজ করেছে, সত্যের পথে থেকেছে, আত্মশুদ্ধি অর্জন করেছে, তারা পরকালে জান্নাতের সুখ লাভ করবে। অন্যদিকে, যারা অন্যায়, দুর্নীতি, লোভ, মোহের কারণে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তারা কঠোর শাস্তি ভোগ করবে।
হাশর সম্পর্কে আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়, এটি শুধুমাত্র মৃত্যুর পরবর্তী একটি বিষয় নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনে আমরা ছোট ছোট হাশরের সম্মুখীন হই। যেমন, যখন আমরা কোনো ভুল করি, তখন তার ফলাফল অবশ্যম্ভাবীভাবে আমাদের সামনে আসে। তাই, প্রতিদিনই আমাদের জীবন আমাদের কর্মের প্রতিফলন হিসেবে একটি হাশরের মঞ্চ তৈরি করে দেয়।
দুনিয়ায় বসবাসকারী মানুষদের উচিত হাশরের দিনকে সামনে রেখে জীবন যাপন করা। অর্থাৎ, যে কোনো কাজ করার আগে এর পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া। কারণ, দুনিয়ায় আমরা যা বপন করব, হাশরের ময়দানে তার ফসল আমরা ঘরে তুলব।
আত্মশুদ্ধি ও হাশরের প্রস্তুতি
আত্মশুদ্ধি এবং নফসের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত হতে পারে এবং সত্যিকার অর্থে হাশরের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। প্রকৃত আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে, এই দুনিয়া একটি ক্ষণস্থায়ী স্থান মাত্র এবং এখানে করা প্রতিটি কাজের জন্য তাকে একদিন জবাব দিতে হবে।
আত্মশুদ্ধির কয়েকটি ধাপ:
- তওবা ও ইস্তিগফার: অতীতের পাপ থেকে মুক্তি লাভের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা।
- আত্মবিশ্লেষণ: প্রতিদিন নিজের কাজ মূল্যায়ন করা এবং ভুল সংশোধনের চেষ্টা করা।
- নফসের নিয়ন্ত্রণ: নিজের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তিকে সংযত রেখে ন্যায়ের পথে চলা।
- নিয়মিত ইবাদত: পার্থনার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা।
- পরোপকার ও দানশীলতা: মানুষকে সাহায্য করা এবং মানবিক গুণাবলির চর্চা করা।
এই সকল উপায় অবলম্বন করলে একজন ব্যক্তি দুনিয়াতে সঠিক পথ অনুসরণ করতে পারে এবং হাশরের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে।
উপসংহার
দুনিয়া এবং হাশরের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট – একদিকে দুনিয়া হলো কর্মের ক্ষেত্র, যেখানে মানুষ তার ইচ্ছামতো কাজ করতে পারে, অন্যদিকে হাশর হলো সেই কর্মের ফলাফল ঘোষণার স্থান। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু হাশরের বিচার চিরন্তন। তাই আমাদের উচিত দুনিয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা, যাতে হাশরের দিনে আমরা সৃষ্টিকর্তার নিকট সফল হতে পারি।
আমরা যদি দুনিয়াকে শুধুমাত্র ভোগের জায়গা মনে করি, তাহলে আমরা হাশরের বিচারে অসফল হবো। কিন্তু যদি আমরা দুনিয়াকে আত্মশুদ্ধির একটি পথ হিসেবে গ্রহণ করি, তাহলে আমাদের জন্য হাশরের দিন এক শান্তির বার্তা বয়ে আনবে। সুতরাং, আমাদের উচিত প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যবান মনে করে জীবন যাপন করা, যেন হাশরের দিন সঠিক পথে থাকি।