কেন কিছু মানুষ সহজেই রিপুর দাসত্বে আবদ্ধ হয়ে পড়ে?

রিপু বা মানসিক আবেগগত ক্ষুধা, যা মানুষের আবেগ, বাসনা, শখ, লোভ, ক্রোধ, অহংকার ইত্যাদি দ্বারা পরিচালিত হয়, মানুষের অন্তরের অন্ধকার দিক। শাস্ত্র মতে, রিপুর একাধিক অবস্থা জীবনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রিপু বা অনুকুল বাসনা মানুষের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদার জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, এবং যে কোনো মানুষ যদি এই রিপু বা আবেগগত চাহিদাগুলোর দাসত্বে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তাহলে তার জীবনে এক অন্ধকার যুগ শুরু হয়। কিন্তু কেন কিছু মানুষ সহজেই রিপুর দাসত্বে আবদ্ধ হয়ে পড়ে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের মনোযোগ দিতে হবে মানুষের মানসিকতা, অভ্যাস, শাস্ত্রীয় শিক্ষা, পরিবেশ এবং প্রভাবের ওপর।

১. অভ্যাস এবং পরিবেশের প্রভাব

মানুষের জীবন অনেকাংশে তার অভ্যাস দ্বারা নির্ধারিত হয়। যদি কোনো ব্যক্তি তার জীবনের প্রথম পর্যায়ে থেকেই বস্তুগত সুখের দিকে আকৃষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে সে রিপুর দাসত্বে সহজেই আবদ্ধ হতে পারে। আধুনিক সমাজে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য আধুনিক প্ল্যাটফর্মে প্রচুর পরিমাণে ভোগ বিলাসিতা, মুনাফা এবং বাহ্যিক প্রশংসার জন্য মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত বাসনা বৃদ্ধি পায়। একে বলে ‘ভোগবাদী মনোভাব’। যখন কোনো ব্যক্তি সস্তা আনন্দে বা ভোগে মগ্ন থাকে, তখন তার অন্তরে রিপু প্রবল হতে থাকে। এই আবেগের চাপেই সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং রিপুর দাসত্বে আবদ্ধ হয়।

২. আত্মবিশ্বাসের অভাব

এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা নিজের আত্মবিশ্বাস এবং মূল্যবোধের অভাবে রিপুর দাসত্বে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা নিজের অস্তিত্ব বা পরিচয় সম্পর্কে সঠিকভাবে জানে না এবং অন্যদের চাহিদা বা অনুকূলতার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। তাদের মনে ভয় থাকে, “আমি যদি অন্যদের মত না হই, তাহলে তারা আমাকে গ্রহণ করবে না।” এই আতঙ্ক তাদেরকে রিপুর কাছে সঁপে দেয়, যাতে তারা সমাজের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এর ফলস্বরূপ, তারা একের পর এক রিপুর শিকার হয়ে পড়ে, যেমন: লোভ, হিংসা, অহংকার, কামনা ইত্যাদি।

৩. রূপান্তরিত সমাজের প্রভাব

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কারণে এখন আরও বেশি করে মানুষ অন্যদের জীবন এবং তাদের সুখের তুলনা করতে শুরু করে। একে বলা হয় ‘সোশ্যাল কম্প্যারিজম’, যেখানে কেউ নিজের জীবনকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে অসন্তুষ্টি বা অতিরিক্ত চাহিদা অনুভব করে। এই চাহিদাগুলি প্রায়ই রিপুর দিকে পরিচালিত করে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যখন সামাজিক মিডিয়ায় অন্যদের সুখী ছবি বা জীবনের সাফল্য দেখে, তখন সে নিজেকে তাচ্ছিল্য বোধ করতে থাকে এবং “এই কিছুর জন্য আরও কিছু করতে হবে” এই চিন্তাধারা তার ভিতর জন্ম নেয়। অতিরিক্ত চাহিদার কারণে, তারা রিপুর দাসত্বে আটকে যায়।

৪. শিক্ষা এবং আত্মজ্ঞান

মানুষের অন্তর্নিহিত মানসিক শান্তি এবং নিজস্ব উপলব্ধির মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যার মধ্যে আত্মজ্ঞান বা সত্যের উপলব্ধি কম, সে সহজেই রিপুর দাসত্বে আবদ্ধ হয়ে যায়। শাস্ত্রীয় শিক্ষায় বলা হয়েছে, “রিপুর উপাসনা করতে যাওয়া মানে আত্মাবলম্বন থেকে সরে আসা।” আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায়, মানুষের আত্মসমালোচনা বা আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। যদি কাউকে আধ্যাত্মিক বা আত্মানুসন্ধানের দিকে পরিচালিত না করা হয়, তবে সে রিপুর অতিরিক্ত আকর্ষণের শিকার হয়ে পড়ে।

৫. মানসিক দুর্বলতা এবং শোক

মানসিক দুর্বলতা বা অভ্যন্তরীণ শোকও রিপুর দাসত্বে আবদ্ধ হওয়ার একটি বড় কারণ। যদি কোনো ব্যক্তি মানসিকভাবে দুর্বল থাকে এবং তার জীবনে শোক বা দুঃখের কারণ থাকে, তবে সে শোকের মুহূর্তে রিপুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এটি হতে পারে অতিরিক্ত খাবারের প্রতি আকর্ষণ, অতিরিক্ত ঘুমানোর প্রবণতা, বা যেকোনো ধরনের অবাস্তবতা বা মিথ্যা আশার প্রতি মোহ। শোক বা মানসিক দুশ্চিন্তা রিপুর জন্ম দেয় এবং এইভাবে একজন মানুষ তার জীবনের সমস্ত দুঃখের মধ্যে রিপুর দাসত্বে আটকে পড়ে।

৬. আত্মবিশ্লেষণ এবং পরিপূর্ণতার অভাব

যেসব মানুষ নিজেদের আত্মবিশ্লেষণে আগ্রহী নয় এবং যারা স্বকীয়তা বা পরিপূর্ণতা অর্জনের প্রতি উদাসীন, তারা রিপুর দাসত্বে খুব সহজেই আবদ্ধ হয়ে যায়। যাদের জীবন যাপনের কোনও লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই, তারা স্বাভাবিকভাবেই রিপুর আকর্ষণে পড়তে পারে। আত্মবিশ্লেষণ এবং শৃঙ্খলার অভাব তাদের জীবনকে আরও বেশি বিশৃঙ্খল করে তোলে এবং রিপু তাদের মধ্যে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই অভাবেই তারা আবেগগতভাবে অস্থির এবং দীন হয়ে পড়ে।

৭. সংস্কৃতি ও পরিবারের ভূমিকা

প্রথমে যদি কোনও শিশু পরিবারের মধ্যে এসব রিপু বা দোষের আচরণ দেখে, তাহলে সেই অভ্যাস তার মধ্যে প্রতিস্থাপিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো পরিবারে অহংকার, ক্ষুধা বা মিথ্যাচারের চর্চা থাকে, তাহলে সেই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এমন প্রবণতা তৈরি হতে পারে, যা পরে তাদের রিপুর দাসত্বে পরিণত হয়। এছাড়া, যদি সংস্কৃতি এমনভাবে গড়ে ওঠে, যেখানে বাহ্যিক সৌন্দর্য, সম্পদ, বা ক্ষমতা চর্চিত হয়, তবে সেখানে রিপু খুব সহজে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।

শেষকথা

এখন পর্যন্ত আলোচিত বিষয়গুলো থেকে স্পষ্ট যে, রিপুর দাসত্বে আবদ্ধ হওয়া অনেক কারণে সম্ভব হতে পারে, তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো মানসিক দুর্বলতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, এবং চাহিদা পূরণের জন্য অস্থিরতা। মানুষের মাঝে রিপুর দাসত্বের এই প্রবণতা রোধ করার জন্য আত্মজ্ঞান, আধ্যাত্মিক শিক্ষা, সামাজিক সচেতনতা এবং পরিবারিক শৃঙ্খলার প্রয়োজন রয়েছে। মানুষ যদি নিজের অন্তর্দৃষ্টি এবং শান্তির দিকে মনোযোগ দেয়, তবে সে রিপুর চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারে।

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon