অহংকার ও আত্মপরিচয় এই দুটি শব্দের মধ্যে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত কিছু ধারণা রয়েছে, তবে তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। অহংকার এক ধরনের ভুল ধারণা বা মনের অবস্থা যা মানুষের মধ্যে বিশেষ করে আত্মমর্যাদার প্রতি অতিরিক্ত প্রবণতা সৃষ্টি করে, যেখানে অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমবেদনা কমে যায়। অন্যদিকে, আত্মপরিচয় হল একজন ব্যক্তির নিজস্ব মূল্য, পরিচিতি, এবং জীবনযাত্রার প্রতি সচেতনতা। এটি ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার সম্পর্কিত এক সুস্থ ধারণা যা অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে।
অহংকার কি?
অহংকার, যা ইংরেজিতে ‘pride’ হিসেবে পরিচিত, এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তির মনে নিজেকে অন্যদের থেকে উন্নত বা শ্রেষ্ঠ হিসেবে ভাবা হয়। অহংকারে আক্রান্ত ব্যক্তি তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতা উপলব্ধি করতে পারে না এবং মনে করে সে সর্বদা সঠিক। এই অনুভূতি তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অহংকারের মধ্যে অন্যদের অবমূল্যায়ন এবং নিজেদের অতিরিক্ত প্রশংসা করতে গিয়ে একজন ব্যক্তি আত্মবিশ্বাসের পরিবর্তে আত্মবিস্মৃতির দিকে এগিয়ে চলে।
অহংকার এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের অতিরিক্ত মাত্রা, যেখানে কোনো প্রকার শৃঙ্খলা, দয়া বা নম্রতা না থাকে। অহংকারে আক্রান্ত ব্যক্তি কখনোই নিজের ভুল স্বীকার করতে চায় না এবং সবসময় নিজেকে সেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এটা অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও সুষ্ঠু যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, কারণ অহংকারী ব্যক্তি সাধারণত অন্যদের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেয় না এবং তাদের সঙ্গে সহমর্মিতা দেখায় না।
আত্মপরিচয় কি?
আত্মপরিচয় হল একজন ব্যক্তির নিজের সম্পর্কে সচেতনতা, তার আত্মবিশ্বাস এবং নিজস্ব মূল্যবোধ। আত্মপরিচয়ের মধ্যে এমন একটি ধারণা নিহিত রয়েছে, যেখানে একজন ব্যক্তি নিজের সঠিক পরিচিতি সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং সে নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখে। আত্মপরিচয়ের সঙ্গে অহংকারের কোনো সম্পর্ক নেই, কারণ আত্মপরিচয় স্বাস্থ্যকর আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদার অনুভূতি থেকে উদ্ভূত হয়, যেখানে এক ব্যক্তি নিজের সক্ষমতা ও পরিচিতি উপলব্ধি করে এবং তা অন্যদের সাথে সম্মানজনকভাবে ভাগ করে নেয়।
আত্মপরিচয়ের মধ্যে একজন ব্যক্তি নিজের দুর্বলতাগুলোও স্বীকার করতে পারে এবং নিজের উন্নতির জন্য কাজ করার আগ্রহ দেখায়। এটি জীবনের উদ্দেশ্য, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা সংক্রান্ত একটি গভীর অনুভূতি। আত্মপরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল একজন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত আত্মবিশ্বাস যা তার কর্ম, আচরণ, এবং জীবনযাত্রায় প্রতিফলিত হয়। এমনকি এটি অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রদর্শন করার মাধ্যমে নিজের আত্মবিশ্বাস বজায় রাখে।
অহংকার ও আত্মপরিচয়ের মধ্যে পার্থক্য
১. অতি আত্মবিশ্বাস বনাম প্রকৃত আত্মবিশ্বাস:
অহংকারে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে অতিরঞ্জিতভাবে মূল্যায়ন করে এবং সর্বদা নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে, যদিও তার সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক নাও হতে পারে। অন্যদিকে, আত্মপরিচয় হলো প্রকৃত আত্মবিশ্বাস, যেখানে ব্যক্তি নিজের সক্ষমতার প্রতি সচেতন হলেও সে নিজেকে অন্যদের থেকেও আলাদা বা শ্রেষ্ঠ ভাবতে শুরু করে না। আত্মপরিচয়ে একজন ব্যক্তি তার ভুলও স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে এবং অন্যদের অনুভূতিকে সম্মান করতে জানে।
২. নিজের এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা:
অহংকারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা অনুভব করতে পারে, কিন্তু অন্যদের প্রতি তার মনোভাব তাচ্ছিল্যপূর্ণ হতে পারে। সে নিজের অবস্থানকে সর্বোচ্চ মনে করে এবং অন্যদের সমীহ বা সম্মান দেয় না। এর বিপরীতে, আত্মপরিচয়ে একজন ব্যক্তি তার নিজের মানকে সম্মান জানালেও, অন্যদের প্রতি সম্মান এবং সহানুভূতির অনুভূতি জাগ্রত রাখে। এটি সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং জীবনকে আরও সহজ এবং সুখী করে তোলে।
৩. আত্মবিশ্বাসের মাত্রা:
অহংকারের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে যায়, যা একধরনের আত্মভ্রম সৃষ্টি করে। অহংকারী ব্যক্তি প্রায়শই ভুলে যায় যে, সে একমাত্র নিজের উপকারের জন্য নয়, বরং সমাজের সাথে সম্পর্কিত একটি অঙ্গ। অন্যদিকে, আত্মপরিচয় হল এমন একটি ধারণা যা সত্যিকারের আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে তৈরি হয়, যা একজন ব্যক্তির মানসিক ও সামাজিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
৪. ভুল স্বীকার ও উন্নতি:
অহংকারে আক্রান্ত ব্যক্তি তার ভুল স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকে না এবং মনে করে যে সে কখনো ভুল করতে পারে না। এটি তাকে গর্বিত এবং একাগ্র করে তোলে, তবে তার কোনো উন্নতি সাধিত হয় না। অপরদিকে, আত্মপরিচয়ে একজন ব্যক্তি নিজেকে জানে এবং নিজের দুর্বলতাগুলোকে সংশোধন করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। তার মধ্যে সদয়তা এবং নম্রতা থাকে, এবং সে সবার সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।
৫. মানবিক সম্পর্ক:
অহংকার মানুষের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করতে পারে কারণ অহংকারী ব্যক্তি নিজের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে এবং অন্যদের মান্য করে না। এর ফলে, সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যায় এবং পারস্পরিক সহযোগিতা হ্রাস পায়। অন্যদিকে, আত্মপরিচয়ে ব্যক্তির মধ্যে সহানুভূতি এবং সহযোগিতার মনোভাব থাকে, যা সম্পর্কের ভিত মজবুত করে।
শেষকথা
অহংকার এবং আত্মপরিচয়ের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়, যেখানে অহংকারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার আত্মবিশ্বাসকে অন্যদের প্রতি তুচ্ছ বা অবজ্ঞার মাধ্যমে প্রমাণ করতে চায়, আর আত্মপরিচয়ে একজন ব্যক্তি নিজের আত্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধের মধ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখে এবং অন্যদের সঙ্গে শ্রদ্ধাশীল সম্পর্ক গড়ে তোলে। অহংকারের ফলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়, কিন্তু আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার চারপাশের পৃথিবীকে আরও সুন্দর ও সম্মানজনকভাবে গ্রহণ করতে পারে। তাই, আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করা আমাদের জীবনে অহংকারের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।