মোহ ও মায়ার প্রভাব থেকে মুক্তির উপায়

মোহ এবং মায়া দুটি এমন অবস্থা যা মানুষের মানসিক ও আত্মিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এরা আমাদের চেতনা এবং মনের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে, যার ফলে আমরা অনেক সময় বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমাদের আত্মিক পথচলার জন্য মোহ ও মায়ার প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। তবে এই মুক্তির পথ মোটেই সহজ নয়, কারণ মানুষের মন সহজেই মোহের বা মায়ার অধীনে চলে আসে। কিন্তু এই প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু বিশেষ উপায় এবং পথ রয়েছে, যেগুলি অনুসরণ করলে আমরা সত্যিকার অর্থে মুক্তি লাভ করতে পারি।

১. আত্মপরিচয় এবং আত্মজ্ঞান অর্জন

মোহ এবং মায়ার প্রথম প্রভাবটা পড়ে মানুষের আত্মপরিচয়ে। আমরা নিজেদের যে পরিচয়ে চিহ্নিত করি, তা প্রায়শই আমাদের বাহ্যিক জগতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। আমরা নিজেদের শারীরিক অবস্থা, বৈষয়িক সম্পদ বা সামাজিক অবস্থান দিয়ে চিনি। কিন্তু সত্যিকারের আত্মপরিচয় জানলে আমাদের মন থেকে মোহ ও মায়ার প্রভাব কমতে শুরু করে।

আত্মজ্ঞান অর্জন করার জন্য নিয়মিত ধ্যান, ব্রহ্মচর্য, সাধনা, এবং নিজেকে জানার প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যখন একজন ব্যক্তি নিজের অন্তরের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারে, তখন সে বুঝতে পারে যে বাহ্যিক জগত, অর্থ, সুখ, অথবা দুঃখের ওপর তার মূল পরিচয়ের ভিত্তি নেই। তার প্রকৃত পরিচয় তার আত্মা বা “অচিন্ত্য বস্তু”। এই উপলব্ধি মায়া এবং মোহের চিহ্ন মুছে দেয়।

২. জীবনকে সত্যের দিকে পরিচালনা করা

আমাদের জীবনে মোহ এবং মায়া তখনই প্রবল হয় যখন আমরা বাস্তবতা থেকে দূরে চলে যাই এবং কেবল বাহ্যিকতার দিকে নজর দেই। বাস্তবতা হল আমাদের সত্তার প্রকৃতি, যে সত্তা নিঃশেষ এবং এক। আমরা যদি জীবনকে সর্বদা এই সত্যের দিকে পরিচালিত করতে পারি, তবে আমাদের জীবনে মোহ এবং মায়ার প্রভাব দুর্বল হয়ে যাবে।

এই ধরনের জীবনযাত্রায় সত্যের অনুসন্ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জীবনের প্রতিটি কাজ এবং চিন্তায় সত্যের আলো খুঁজে বের করা আমাদেরকে মায়া থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। এ জন্য নিয়মিত জ্ঞানচর্চা, পড়াশোনা এবং সাধনা অত্যন্ত কার্যকরী।

৩. প্রভাবশালী সম্পর্কগুলো নির্ধারণ করা

মোহ এবং মায়া আমাদের জীবনে এমন সম্পর্কের মাধ্যমে আসে যা আমাদের মনে অহংকার, দখল, বা নির্ভরশীলতার সৃষ্টি করে। এই সম্পর্কগুলোতে যদি আমরা কেবল বাহ্যিক চাহিদা ও বৈষয়িক লাভের দিকে নজর দিই, তবে মায়ার প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়। এজন্য আমাদের সম্পর্কগুলোকে নির্ধারণ করতে হবে কেমন হবে, তারা যদি আত্মিকভাবে সমৃদ্ধ না হয় এবং আমরা যদি নিজেদের গৌরব বা সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হই, তবে মোহ এবং মায়া বেড়ে যাবে। তবে আত্মিক সম্পর্ক, যেখানে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং দয়ার মূলধন থাকে, আমাদের মুক্তির পথ দেখায়।

অতএব, আমাদের সম্পর্কগুলোকে চিন্তা ও গভীর আত্মিক ভিত্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা উচিত।

৪. যোগ্যতা এবং নির্ভরশীলতা মুছে ফেলা

মায়া এবং মোহের প্রভাব বেড়ে যায় যখন আমরা কিছু নির্দিষ্ট বিষয় বা মানুষের ওপর অত্যাধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। আমাদের সকল শক্তি বাহ্যিক জগতের ওপর নিবদ্ধ হয়ে যায়। এ কারণে জীবনকে আরেকভাবে দেখা প্রয়োজন। যা কিছু বাইরে রয়েছে, তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু আমাদের অন্তরের শান্তি এবং সত্য অবিচল থাকে।

যদি আমরা জীবনযাত্রা এমনভাবে পরিচালনা করতে শিখি যাতে আমাদের সুখ বা শান্তি বাহ্যিক অবস্থা বা কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর না করে, তবে মায়া এবং মোহের প্রভাব কমে যাবে।

৫. ধ্যান ও সৃষ্টিকর্মের সাথে সংযুক্ত থাকা

ধ্যান এবং সৃষ্টিকর্মের চর্চা একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে আমরা আমাদের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করতে পারি এবং মায়া ও মোহ থেকে মুক্তি পেতে পারি। ধ্যানের মাধ্যমে আমরা নিজেদের আত্মার সাথে সংযুক্ত হতে পারি, এবং জীবনের ক্ষণস্থায়ী বিষয়গুলোকে পরিপূর্ণভাবে বুঝে শিখতে পারি।

এছাড়া সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে নিজের প্রতিভা এবং দক্ষতার বাস্তবায়ন করে আমরা আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করতে পারি। নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং তা সঠিকভাবে করা আমাদের আত্মিক উন্নতি এবং মায়া থেকে মুক্তি লাভের পথকে সুগম করে।

৬. সাধনা এবং সু-পথে হাঁটা

মায়া এবং মোহের প্রভাব কমানোর একটি প্রধান উপায় হল সত্যের পথে চলা এবং জীবনের সমস্ত কাজকে সাধনার মাধ্যমে পূর্ণ করা। আমাদের নীতিগতভাবে সঠিক কাজগুলো করতে হবে, অন্যথায় জীবনের তত্ত্ব এবং বোধগুলো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।

অতএব, সচ্ছাতার দিকে চলতে, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে, এবং অঙ্গীকারবদ্ধভাবে আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করাই মায়া ও মোহ থেকে মুক্তির শক্তিশালী উপায়।

৭. পৃথিবী ও সময়ের সত্যিকারের প্রকৃতির উপলব্ধি

পৃথিবী এবং সময়ের প্রকৃতি উপলব্ধি করার মাধ্যমে আমাদের মায়া ও মোহ থেকে মুক্তি হতে পারে। এই পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী এবং সময়ও চলমান। একে অস্থায়ী ভাবেই দেখলে, আমরা মায়ার প্রতি অস্থির হয়ে পড়ি না। আমরা যদি জীবনকে সময়ের ব্যবহারে দেখি, এবং জানি যে আমাদের কিছুই স্থায়ী নয়, তবে মায়া ও মোহ আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারবে না।

শেষকথা

মোহ ও মায়ার প্রভাব থেকে মুক্তি একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যা সঠিক চিন্তা, আত্মজ্ঞান এবং অভ্যন্তরীণ শান্তির প্রতি গভীর দৃষ্টি দিতে হয়। তবে এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা কেবল মানসিক এবং আত্মিক শ্রমের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে, সত্যের দিকে হাঁটতে, এবং আত্মপরিচয় উপলব্ধি করে আমরা মায়া ও মোহের প্রভাব থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি।

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon