সাত আসমানের রহস্য ও আধ্যাত্মিক ভ্রমণ

মানুষ চিরকালই চেয়েছে জানতে তার অস্তিত্ব কোথা থেকে এসেছে, এবং কোথায় যাবে। আত্মা, চেতনা, আকাশ এইসব প্রতীকী শব্দ দিয়ে মানুষ নিজের ভেতরের এবং বাইরের জগত বোঝার চেষ্টা করেছে। ঠিক এমন এক রহস্যময় ধারণা হলো “সাত আসমান”। এই শব্দটি কোরআনে যেমন এসেছে, তেমনি বাউল গানে, দেহতত্ত্বের সাধনায় এবং আধ্যাত্মিক দর্শনে গভীরভাবে মিশে আছে। আজ আমরা এই “সাত আসমান” ধারণার ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও দেহতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করবো।

কোরআন ও ইসলামিক ভাবধারায় সাত আসমান

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেনঃ

“তিনিই সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান স্তরে স্তরে…” – সূরা আল-মুলক (৬৭:৩)

“আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং পৃথিবীর মধ্যে তাদের সদৃশ।” – সূরা তালাক (৬৫:১২)

এখানে “সাত আসমান” বলতে সাধারণত মহাবিশ্বের স্তরবিন্যাস, ফেরেশতাদের বসবাসের বিভিন্ন জগত বা আধ্যাত্মিক স্তর বোঝানো হয়। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস করা হয়, আসমানগুলোর প্রত্যেকটি ভিন্ন ধরণের সৃষ্টি ও শক্তি দ্বারা পূর্ণ এবং প্রতিটি আসমানের বিশেষ রক্ষক ফেরেশতা রয়েছেন।

নবীজীর মিরাজ ও সাত আসমান

মিরাজের রাতে নবী মুহাম্মদ একে একে সাত আসমান অতিক্রম করেন এবং প্রতিটি স্তরে বিভিন্ন নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যেমনঃ

  • ১ম আসমানে: আদম আ. (শুরু বা মানবতার মূল)
  • ২য় আসমানে: ঈসা আ. ও ইয়াহইয়া আ. (নবুয়তের মিশ্রধারা)
  • ৩য় আসমানে: ইউসুফ আ. (সৌন্দর্য ও হৃদয়ের পরিশুদ্ধি)
  • ৪র্থ আসমানে: ইদরিস আ. (জ্ঞান ও ধ্যান)
  • ৫ম আসমানে: হারুন আ. (সেবাপরায়ণতা)
  • ৬ষ্ঠ আসমানে: মূসা আ. (তাওরাত, কঠোরতা)
  • ৭ম আসমানে: ইব্রাহিম আ. (আত্মসমর্পণ ও তাওহীদের মূল)

এই সাত আসমান পেরিয়ে নবী “সিদরাতুল মুনতাহা”“আরশে আজীম” পর্যন্ত যান, যেখানে কোনো ফেরেশতাও পৌঁছাতে পারে না। এই ভ্রমণ কেবল বাহ্যিক জগতের বর্ণনা নয়, বরং আত্মার উন্নয়নের প্রতীক যা একটি একক সত্ত্বা কিভাবে ধাপে ধাপে পরম সত্যের দিকে এগিয়ে যায়, তারই প্রতিচ্ছবি।

আধ্যাত্মিকতায় সাত আসমানঃ আত্মার স্তরবিন্যাস

আধ্যাত্মিক সাধনায় “সাত আসমান” মানে আত্মার উন্নয়নের সাতটি ধাপ বা স্তর। এই স্তরগুলো:

১. নফসে আম্মারা – কুপ্রবৃত্তিপূর্ণ আত্মা ২. নফসে লাওয়ামা – অনুশোচনাকারী আত্মা ৩. নফসে মুলহিমা – অনুপ্রেরণাপ্রাপ্ত আত্মা ৪. নফসে মুতমাইন্না – শান্ত আত্মা ৫. নফসে রাদিয়া – সন্তুষ্ট আত্মা ৬. নফসে মারদিয়া – আল্লাহর সন্তুষ্ট আত্মা ৭. নফসে কামিলা – পরিপূর্ণ আত্মা

এই স্তরগুলোর মধ্য দিয়ে সাধক নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেন এবং শেষতক পরম এর নৈকট্য লাভ করেন। সাত আসমান, এই দৃষ্টিতে, আত্মার উত্থানের পথ; পৃথিবীর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে চেতনায় প্রবেশ।

বাউল দর্শন ও দেহতত্ত্বে সাত আসমান

বাউল বা লালন দর্শনে “সাত আসমান” মানে বাইরের কোনো জগত নয়, এটা সম্পূর্ণরূপে দেহের ভেতরের সাধনার স্তর। লালন ফকির বলেন:

“দেহতত্ত্বে আছে রে ভাই সাত আসমান একখানে খুললে পরে খোলে আরেক জান।”

এখানে প্রতিটি “আসমান” বা “জান” হলো একেকটি শক্তিকেন্দ্র বা চক্র, যা ধাপে ধাপে খুলে যেতে থাকে সাধনার মাধ্যমে।

সাতটি গোপন শক্তিকেন্দ্র (চক্র):

১. মূলাধার – মেরুদণ্ডের গোড়ায়; টিকে থাকা ও নিরাপত্তা। ২. স্বাধিষ্ঠান – নাভির নিচে; কামনা, সৃজনশীলতা। ৩. মণিপুর – নাভিকেন্দ্র; আত্মবিশ্বাস ও শক্তি। ৪. অনাহত – হৃদয়কেন্দ্র; প্রেম ও করুণা। ৫. বিশুদ্ধ – গলায়; সত্য ভাষণ ও আত্মপ্রকাশ। ৬. আজ্ঞা – ভ্রূমধ্য; অন্তর্জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি। ৭. সহস্রার – মস্তিষ্কের উপরের অংশ; চেতনার চূড়ান্ত স্তর।

প্রতিটি চক্র জাগ্রত হলে সাধক এক ধাপ এগিয়ে যান নিজের সত্যরূপ বা “আসল মন” এর দিকে। লালনের ভাষায়, “যে প্রেম জানে সে কাম করে না, যে কাম জানে সে প্রেম জানে না।”

সাত আসমানের মিলনবিন্দু: আত্মজাগরণ

পবিত্র কোরআন এর সাত আসমান, আধ্যাত্মিকতায় আত্মার স্তর, এবং দেহতত্ত্বে গোপন শক্তিকেন্দ্র সবটাই যেন একই সুতোয় বাঁধা। উদ্দেশ্য একটাই, নিজের ভেতরের ‘আমি’কে সরিয়ে দিয়ে চেতনার মূল উৎসে পৌঁছানো। কারও কাছে সেটা আল্লাহ, কারও কাছে “মন”, আবার কারও কাছে ব্রহ্মতত্ত্ব।

সাত আসমান কোনো ভৌতিক স্থান নয়, এটা এক আধ্যাত্মিক মানচিত্র যা আপনাকে ভেতরের সত্ত্বার দিকে নিয়ে যায়।

শেষকথা

“সাত আসমান” একটি অলৌকিক শব্দ, যার গভীরতা আমাদের ভাবনার সীমা ছাড়িয়ে যায়। এটি কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস নয়; এটি একটি চেতনার পথ, আত্মার অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ, এবং নিজের সত্যরূপে পৌঁছানোর সিঁড়ি। ইসলামিক, আধ্যাত্মিক এবং বাউল দর্শন এই তিনটিই ভিন্নরূপে একই সত্য বলছেঃ

“যদি মন পায় মানুষের দেখা, তবে খুঁজে পাবি সেই সাত আসমানের ঠিকানা।”

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon