মরণের আগে মরতে হবে: এর অর্থ কী?

মৃত্যু একটি চিরন্তন সত্তা, যা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীতে সব কিছু আসে এবং চলে যায়, তবে একমাত্র মৃত্যুই একমাত্র অবশ্যম্ভাবী সত্য যা আমাদের সবাইকে একদিন মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে, আমরা যদি মৃত্যুকে অন্যভাবে দেখি, তবে আমাদের জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে সম্পর্কের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভূত হয়। “মরণের আগে মরতে হবে” কথাটি যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে এর মধ্যে নিহিত রয়েছে আত্মজ্ঞান, আত্মমৃত্যু, এবং মরণের পরেও একটি পরিপূর্ণ জীবন বাঁচানোর আকাঙ্ক্ষা।

আধ্যাত্মিক মৃত্যুর ধারণা

আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মৃত্যু কেবল শারীরিক মৃত্যু নয়, বরং আত্মিক মৃত্যু। এটি সেই সময় যখন ব্যক্তি তার অহংকার, তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা, এবং তার অবচেতন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তি লাভ করে। আত্মিক মৃত্যু এমন একটি অভিজ্ঞতা, যখন একজন ব্যক্তি তার মনের সমস্ত রকমের আবেগ, হিংসা, লোভ, ভয়, এবং ঈর্ষা থেকে পরিত্রাণ পায়। এটি তার মধ্যে একটি নতুন দৃষ্টি, নতুন জীবনদৃষ্টি এবং নতুন উপলব্ধি সৃষ্টি করে। আধ্যাত্মিক মৃত্যুর মাধ্যমে, ব্যক্তি আসলেই বুঝতে পারে, যে আসল ‘আমি’ সে নয়, যা শারীরিক সত্তায় আবদ্ধ, বরং তার অস্তিত্বের চিরন্তন আত্মা। এই মৃত্যুই হল ‘মরণের আগে মরার’ ধারণা।

অহংকারের মৃত্যু

আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে অহংকার। অহংকার হলো সেই শক্তি যা আমাদের আত্মবিশ্বাসের সাথে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, আমাদের মনে অস্থিরতা এবং অশান্তি সৃষ্টি করে। অহংকারের মৃত্যু হলে, আমাদের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। যখন আমরা আত্মসমালোচনা এবং নিজেকে পরিচয় দিতে শিখি, তখন অহংকার ধীরে ধীরে ধ্বংস হতে শুরু করে। এক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের আত্মবিশ্বাস ও অহংকারের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং আমরা উপলব্ধি করি, যে সত্যিই আমরা কেউ নয়, আমাদের অস্তিত্বের প্রকৃত ভিত্তি কেবল মহাশক্তির অংশ হিসেবে।

অহমিকার পরিত্রাণ

আধ্যাত্মিক জীবনে আত্মমৃত্যু অর্জন করতে হলে আমাদের অহমিকা বা ‘আমি’ পরিচয়ের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত ধারণা ছেড়ে দিতে হবে। ‘আমি’ এবং ‘আমার’ এই দুটি শব্দ আমাদের জীবনের ক্ষুদ্র দৃষ্টি ও সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। যখন আমরা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ বুঝতে শুরু করি এবং সেগুলোতে শুদ্ধি আনা যায়, তখন আত্মিক মৃত্যু অর্জিত হয়। একটি মানুষ যখন সত্যিকার অর্থে ‘আমি’ শব্দটি পরিত্যাগ করে, তখন সে উপলব্ধি করতে পারে যে, সে একাত্ম সত্তা, বিশ্বমাতার অঙ্গ। এই উপলব্ধি হলে, মরণের আগে মরার ধারণাটি আরো সুস্পষ্ট হয়, যেখানে জীবনের সব সম্পর্ক, কামনা, এবং লোভ মৃত্যুর মতো ক্ষুদ্র হয়ে যায়।

নিরাকার ব্রহ্মের উপলব্ধি

ব্রহ্ম বা সৃষ্টির মূল শক্তি, যা সব কিছু ধারণ করে, তা কোনো নির্দিষ্ট রূপে সীমাবদ্ধ নয়। নিরাকার ব্রহ্মকে উপলব্ধি করার মাধ্যমে, ব্যক্তি তার শারীরিক দৃষ্টি থেকে মুক্তি পায়। আধ্যাত্মিক মৃত্যুর মাধ্যমে, তিনি নিজেকে সবকিছুর সাথে একীভূত করে দেখতে পারেন। পৃথিবী, আকাশ, জঙ্গল, নদী, সমুদ্র, সুর্য সবকিছু এক সত্তায় মিলিত হয়ে এক সুন্দর সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ ধারণ করে। এই উপলব্ধি আধ্যাত্মিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এটি আত্মাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার ও তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেতনা তৈরি করে।

জীবনের প্রতি গভীর প্রেম

মরণের আগে মরার আরও একটি দিক হলো জীবনের প্রতি গভীর প্রেম ও সহানুভূতির বিকাশ। যখন আমরা সত্যিকারভাবে অনুভব করি যে, আমাদের প্রত্যেকটি মুহূর্তই মূল্যবান, তখন আমাদের জীবনের প্রতি মনোভাব পরিবর্তিত হয়। মৃত্যুর পরবর্তী বিশ্বের প্রতি বিশ্বাস বা ভয় না রেখেই, আমরা এই জীবনটিকে পূর্ণভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি। এই প্রেম ও সহানুভূতি কেবল মানুষের প্রতি নয়, বরং সকল জীবের প্রতি, প্রকৃতি এবং মহাশক্তির প্রতি। আমাদের মধ্যে যখন এই প্রেম জাগ্রত হয়, তখন আমরা স্বভাবতই অন্যদের জন্য সহানুভূতিশীল হয়ে উঠি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, জীবনের প্রতি গভীর প্রেমই আসল আধ্যাত্মিক মৃত্যু, যা আমাদের আত্মার পরিপূর্ণ মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।

জীবনের সঠিক উদ্দেশ্য

“মরণের আগে মরতে হবে” মানে হল, আমাদের জীবনকে একটি সঠিক উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিচালনা করা। আমরা যদি জীবনের ভেতর দিয়ে চলতে গিয়ে তার অস্থিরতা এবং ভোগবিলাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকি, তাহলে আমরা আসল উদ্দেশ্যকে হারিয়ে ফেলি। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে, জীবন তখনই সফল হয় যখন আমরা আত্মসন্ধান করি এবং সেই আত্মাকে সৃষ্টির সাথে একীভূত করি। জীবনের উদ্দেশ্য কেবল বাহ্যিক সাফল্য বা আনন্দ খুঁজে পাওয়া নয়, বরং এটি আত্মিক উন্নতি ও মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়া।

আত্মমুক্তি এবং শুদ্ধি

মরণের আগে মরতে হলে আমাদের নিজের জীবনের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের ভুল ধারণা, খারাপ অভ্যাস, এবং মানসিক দুর্বলতা থেকে মুক্তি পেতে হবে। যখন আমরা আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের উপর কাজ করি এবং নিজেদের শুদ্ধি লাভ করি, তখন আমরা আত্মমুক্তির পথে চলি। আত্মমুক্তি অর্জন করলেই আমরা বুঝতে পারি, জীবনের সব কিছু অস্থির ও পরিবর্তনশীল, এবং এর মাধ্যমে আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন পূর্ণতা লাভ করে। মরণের আগে মরতে হবে, অর্থাৎ আমাদের জীবনকে শুদ্ধ এবং মঙ্গলময় করতে হবে।

উপসংহার

মরণের আগে মরতে হবে, এটি কেবল একটি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ নয়, বরং একটি জীবনদৃষ্টি যা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি বুঝতে সহায়তা করে। আত্মিক মৃত্যু এমন একটি প্রক্রিয়া যা আমাদের সমস্ত আবেগ, ইচ্ছা এবং অহংকার থেকে মুক্তি দেয়, আমাদের আত্মাকে সঠিকভাবে চিনতে শেখায়, এবং আমাদের জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রেম সৃষ্টি করে। মৃত্যু কেবল শারীরিক অঙ্গীকার নয়, বরং আত্মার পূর্ণতা ও মুক্তির প্রক্রিয়া। মরণের আগে মরতে পারলেই আমরা আমাদের জীবনকে সার্থক ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাঁচতে পারি, এমন এক জীবনের দিকে যেটি কেবল আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা এবং শুদ্ধির দিকে পরিচালিত।

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon