আজকের যুগে মানুষ প্রযুক্তির সাথে এতটাই অভ্যস্ত যে, নিজেকেও অনেক সময় একটা যন্ত্রের মতো ভাবতে শুরু করে। কিন্তু যদি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাই যে প্রযুক্তি আমাদেরকে শুধুই ব্যবহার দেয়নি, দিয়েছে আত্মপরিচয়ের নতুন ভাষা। আজ আমরা একটি মোবাইল ফোনের সাথে তুলনা করে মানুষের আত্মা, মন এবং জ্ঞানকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু যুক্তিনির্ভর নয়, বরং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানেও সাহায্য করবে।
দেহ: মোবাইলের হার্ডওয়্যার
প্রথমত, আমরা যদি মোবাইল ফোনের দিকে তাকাই, তার বডি বা হার্ডওয়্যারটাই চোখে পড়ে। এই বডি হচ্ছে ফোনের দৃশ্যমান অংশ; স্ক্রিন, ক্যামেরা, কেসিং ইত্যাদি। এখন চিন্তা করুন, মানুষের শরীরও তেমনি। চোখ, নাক, মুখ, হাত, পা; সবই দৃশ্যমান। কিন্তু একটা মোবাইল শুধুমাত্র হার্ডওয়্যার দিয়ে কিছুই করতে পারে না, যতক্ষণ না তার মধ্যে সফটওয়্যার থাকে।
আত্মা: অপারেটিং সিস্টেম
যে জিনিসটি মোবাইলকে কার্যকর করে তোলে, তা হলো অপারেটিং সিস্টেম; অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস বা অন্য কিছু। এটি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু চোখে দেখা যায় না। আত্মাও ঠিক তেমনই। দেহের ভিতরে বসবাসকারী একটি অদৃশ্য অথচ সচল শক্তি। আত্মা না থাকলে দেহ কেবল একটা খোলস মাত্র।
মজার বিষয় হলো, একটা পুরনো মোবাইল অনেক বছর পড়ে থাকলেও, যদি তার হার্ডওয়্যার ঠিক থাকে এবং চার্জ দেওয়া হয়, তাহলে সে আবার চালু হয়ে যেতে পারে। তার অপারেটিং সিস্টেম হারিয়ে যায় না। এটি বোঝায়, আত্মা ধ্বংস হয় না; শুধু সাময়িক ঘুমায়। সঠিক পরিস্থিতিতে আবার তা জেগে ওঠে। ধর্মীয় ভাষায়, এই অপারেটিং সিস্টেমই পরমাত্মা। এবং চার্জ বা বিদ্যুৎ হচ্ছে জীবাত্মা, যা দেহে প্রাণ সঞ্চার করে।
মন: মোবাইলের র্যাম
প্রতিটি মোবাইল ফোনে থাকে একটি RAM (Random Access Memory), যেখানে অ্যাপগুলো সাময়িকভাবে কাজ করে। আমাদের মনও ঠিক তেমনই। চিন্তা, কল্পনা, সিদ্ধান্ত, ভয়, ভালোবাসা; সব কিছু মনেই সংঘটিত হয়। মনের উপরে নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মানুষ কোনো কাজেই স্থির হতে পারে না।
র্যাম যেমন বেশি হলে ফোন বেশি স্মার্ট হয়, তেমনি মনের বিশুদ্ধতা, প্রশান্তি এবং প্রশিক্ষণ থাকলে মানুষ হয় জ্ঞানী ও স্থির। হিন্দু দর্শনে একে বলে “মনঃসংযম”। ইসলামেও বলা হয়, “নফস” যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে তা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
আমরা যখন বলি “আমি করিমকে চিনি”, আমরা আসলে করিমের দেহকে নয়, তার চিন্তা, মন, ব্যক্তিত্ব এবং অভ্যাসকেই চিনি। করিম যা করে, তা মূলত তার মন থেকে পরিচালিত। এই মনই রিপু বা প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়।
জ্ঞান: অ্যাপ্লিকেশনস
একটা ফোনে যদি শুধু অপারেটিং সিস্টেম থাকে কিন্তু কোনো অ্যাপ না থাকে, তাহলে সেটা তেমন কার্যকর নয়। তেমনি, মানুষও আত্মা-মন-দেহ থাকলেও, যদি জ্ঞান না থাকে, তাহলে তার পরিচয় অসম্পূর্ণ। অ্যাপ্লিকেশন যেমন গুগল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ; প্রতিটি কাজের জন্য ভিন্ন অ্যাপ দরকার, তেমনি মানুষের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জ্ঞানের প্রয়োগ রয়েছে। কেউ চিকিৎসাবিজ্ঞান শেখে, কেউ সঙ্গীত, কেউ ব্যবসা।
এই অ্যাপগুলো সময়ের সাথে আপডেট হয়। তেমনি মানুষের জ্ঞানও চর্চার মাধ্যমে বাড়ে। কেউ যদি মোবাইলে নতুন অ্যাপ না নামায়, সে পিছিয়ে পড়ে। মানুষও যদি নিজেকে জ্ঞানচর্চায় যুক্ত না রাখে, তবে তার মন দুর্বল হয়ে পড়ে।
বিদ্যুৎ: জীবাত্মা
মোবাইল যতই দামি হোক, যত আধুনিক ফিচারই থাকুক, যদি ব্যাটারিতে চার্জ না থাকে, তাহলে সেটি অচল। এই চার্জই মানুষের জীবাত্মার প্রতীক। এটি এক ধরণের চলমান শক্তি, যা দেহে প্রবেশ করে এবং আবার বেরিয়ে যায়। এই শক্তি যখন দেহ ত্যাগ করে, তখন আমরা বলি; মানুষটি মারা গেছে। অথচ আত্মা ধ্বংস হয়নি, হার্ডওয়্যারও তখনো আছে। কিন্তু চার্জ (জীবাত্মা) নেই বলেই কিছু কাজ করছে না।
যুক্তির জায়গা: যেহেতু মোবাইলেরও একজন স্রষ্টা আছেন…
এখন আসা যাক একটি গভীর প্রশ্নে; যদি এতটুকু যন্ত্রের একটি ডিজাইনার থাকে, তাহলে মানুষ নামক এই জটিল, চমৎকার, ভারসাম্যপূর্ণ এবং চিন্তাশীল জীবটির কি কোনো স্রষ্টা নেই?
একটা মোবাইল তৈরি হয় হাজারো ইঞ্জিনিয়ারের চিন্তা, পরিকল্পনা ও ডিজাইন অনুযায়ী। কোথায় কীভাবে সার্কিট থাকবে, কোন বোতাম কোথায় থাকবে, কীভাবে চার্জিং হবে সবই প্রি-প্ল্যানড। আবার একেকটা ফোনের ক্যামেরা ভালো, একেকটা গেমিং ভালো, মানে, প্রতিটি ফোন তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাস্টমাইজড।
তেমনি, মানুষেরও জন্ম হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে। কেউ সংগীতের জন্য জন্মায়, কেউ সেবার জন্য, কেউ জ্ঞানের জন্য। প্রত্যেকটি মানুষ আলাদা কারণ নিয়ে এসেছে, কারণ তাকে এমন করে বানানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কে বানিয়েছে?
যে যেমন ব্যবহারকারী, সে তেমন ফোন কিনে। আপনি যদি শুধু ফোনে কল করতে চান, তবে আপনার দরকার নেই আইফোন। আপনি যদি ছবি তুলতে ভালোবাসেন, তাহলে আপনি কিনবেন ক্যামেরা ফোকাসড ফোন। তাই, এই পৃথিবীতে যেই আত্মাগুলো এসেছে, তাদের প্রতিটি আত্মাই একেকটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে। এবং এই ডিজাইন যে করেছে, সেই আমাদের স্রষ্টা।
শেষ কথা: নিজেকে জানুন, মোবাইলের মত করে
আমরা যদি সত্যিই নিজেকে জানতে চাই, তাহলে শুধু দেহ দেখলে হবে না। দেখতে হবে নিজের অপারেটিং সিস্টেম অর্থাৎ আত্মা কতটা সচল। জানতে হবে, মনের র্যাম কতটা পরিষ্কার ও প্রশিক্ষিত। যাচাই করতে হবে, আমরা কী কী অ্যাপ ব্যবহার করছি অর্থাৎ জ্ঞানচর্চা করছি কি না। সর্বোপরি, আমাদের নিজেদেরকে সেই চার্জ বা জীবাত্মার সাথে সংযুক্ত রাখতে হবে, যার মাধ্যমে দেহ-মন-আত্মা সক্রিয় থাকে।
সবশেষে, আমরা যদি মেনে নেই যে একটি মোবাইল ফোন আপনা আপনি তৈরি হতে পারে না, তাহলে এটাও মানতে হবে যে মানুষ নামের এই জটিল, সৃষ্টিশীল সত্ত্বাও নিজে নিজে তৈরি হয়নি। তারও নিশ্চয়ই একজন পরিকল্পক, একজন স্রষ্টা আছেন।