দেহতত্ত্ব: আত্মসাধনার রহস্যময় পথ

বাংলা মরমীয়া ভাবধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক ফকির লালন শাহ। তিনি ছিলেন না কোনো প্রতিষ্ঠিত ধর্মের প্রচারক, বরং ছিলেন আত্ম-অন্বেষণের এক অনন্য সাধক। লালনের দর্শন বহুমাত্রিক। তাঁর গান, তাঁর ভাবনা, সবকিছুতেই ছড়িয়ে আছে গভীর আধ্যাত্মিকতার সুর। তাঁর ভাবচিন্তার অন্যতম ভিত্তি হলো “দেহতত্ত্ব” একটি এমন আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে মানুষের দেহকেই সাধনার ক্ষেত্র ও মুক্তির মাধ্যম বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাহ্যিক দেহ নয়, অভ্যন্তরীণ রহস্যের পথ

লালনের দৃষ্টিতে দেহ কেবল মাংসপিন্ড নয়, বরং এক অলৌকিক যন্ত্র। এই দেহের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ‘পরমতত্ত্ব’, ‘সত্য’, ‘আত্মা’ এবং ‘অলৌকিক ঘর’। তিনি বলেন, “এই দেহেতে রসের ধাম, ভাব না জানলে তত সবই মিথ্যা কাম।” অর্থাৎ, দেহের ভেতরে যে মহারস বা তত্ত্বের ধাম, তা শুধুই জ্ঞানে, ভাবনাতে ধরা যায়, দেখা যায় না। এই তত্ত্ব জানাই দেহতত্ত্বের সাধনা।

দেহ সাধনার অনিবার্যতা

লালনের মতে, যে ব্যক্তি আত্মাকে জানতে চায়, তাকে দেহকেই জানতে হবে। কারণ আত্মা এই দেহেই বাস করে। দেহ যদি অপবিত্র হয়, তবে সেই দেহে কখনো আত্মার অনুভব আসবে না। লালনের এক গানে আমরা পাই:

“আপন দেহে কর সংসার,
তাজে তাহা কর না বিচাৰ।”

অর্থাৎ, নিজের দেহই হলো আসল সংসার। আত্মিক অভ্যুদয়ের জন্য এই দেহেই করতে হবে চর্চা, উপলব্ধি ও শুদ্ধিকরণ।

দেহতত্ত্বে নারী-পুরুষ দর্শন ও কাম-নিয়ন্ত্রণ

লালনের দেহতত্ত্বের একটি গভীর দিক হলো নারী-পুরুষ সম্পর্ক ও কামনা বিষয়ে তাঁর ভাবনা। লালন কখনো যৌনতাকে অস্বীকার করেননি, বরং তিনি বলেছিলেন কামনাকে উপলব্ধি ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

“নারী না পুরুষ কেরে কহ মুনীজন?”
এই প্রশ্ন লালন বারবার করেন। তার উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেয়ে তার গভীরতা উপলব্ধি করাই গুরুত্বপূর্ণ। দেহে নারী ও পুরুষ, ইন্দ্রিয় ও মন, আত্মা ও চেতনা সবই এক মঞ্চে অবস্থান করছে। এই সমন্বয়ের মধ্যেই রয়েছে মুক্তির চাবিকাঠি।

দেহতত্ত্বে গুরুর ভূমিকা

লালনের দেহতত্ত্বে গুরু শুধু বাইরের কোনো ব্যক্তি নন, বরং এক অভ্যন্তরীণ আলো। তিনি বলেন,

“আপন গুরু আপনি চিন,
গুরুর তত্ত্ব গুরুর ভিতর বিন।”

এখানে “আপন গুরু” বলতে বুঝানো হয়েছে সেই চেতনা বা সচেতন সত্তাকে, যিনি দেহতত্ত্বের পথে সাধককে পথ দেখান। এই গুরু পাওয়া যায় আত্মসাধনায়, বাহ্যিক আশ্রমে নয়।

দেহতত্ত্ব ও যোগতত্ত্বের মিল

লালনের দেহতত্ত্ব অনেকাংশেই যোগ দর্শনের সাথে সম্পর্কিত। যেমন, তিনি ‘চাক্র’, ‘নাড়ি’, ‘স্বর’, ‘শূন্য’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা দেহাভ্যন্তরের শক্তিকেন্দ্র বা চক্রগুলির কথা বলে।
যেমন:
“ধন্য ধন্য বলি তারে,
বেঁধেছে এমন ঘর শূন্যের উপর পোস্তা করে।
সবে মাত্র একটি খুঁটি, খুঁটির গোড়ায় নাইকো মাটি…”

এই ঘর দেহের মধ্যেকার শক্তিকেন্দ্র, যাকে চেতনা জাগ্রত করে টের পাওয়া যায়।

দেহই মুক্তির পথ, দেহই জ্ঞানভাণ্ডার

লালনের মতে, দেহকে না জেনে কেউ ঈশ্বর বা সত্যকে জানতে পারে না। এই দেহের মধ্যে যে সত্তা বাস করে, তার পরিচয় জানলেই সত্যিকারের মুক্তি সম্ভব।

“যে জন আপন খবর জানে, সে জন ভজে রে…”
এই ‘আপন খবর’ মানে নিজের দেহ, মন, আত্মা, কামনা, অনুভব সবকিছুর নিরীক্ষণ।

সারকথা

ফকির লালনের দেহতত্ত্ব আমাদের এক গভীর বার্তা দেয় যে মুক্তির জন্য বাইরে ছুটতে হবে না, নিজের দেহের মধ্যেই রয়েছে সমস্ত রহস্য। যে দেহকে আমরা অবহেলা করি, সেই দেহই হলো চেতনার ঘর, প্রেমের ঘর, পরম সত্যের ঘর। লালনের দেহতত্ত্ব শুধুই দর্শন নয়, এটি এক জীবন্ত সাধনার পথ, যে পথে হাঁটলে আপনি নিজেকেই নতুন করে চিনবেন।

আপনি যদি লালনের এই দেহতত্ত্ব অনুসরণ করে আত্মানুসন্ধানের পথ খুঁজতে চান, তবে আপন জ্ঞানকেই দেহের গুরু মানতে হবে। কেননা, গুরু বাইরের কেউ নয়, আপনার চেতনার আলোয় জেগে ওঠা সেই অভ্যন্তরীণ বোধই আপনার সত্যিকারের পথপ্রদর্শক।

Leave a Comment

Let’s make something new, different and more meaningful or make thing more visual or Conceptual ? Just Say Hello ! Contact Icon